ভূমিকা
সীমা পার থেকে আসা আতঙ্কবাদের খবর তো আমরা সবাই শুনেছি, কিন্তু এবার সীমা পার থেকে আতঙ্ক বাদ এর খবর নয়, ভালোবাসার খবর আসছে, ২০২০ সালে করোনার কালো ছায়া পুরো পৃথিবীকে দুঃখের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল। প্রচুর মানুষ সজনহারা হয়েছে, কর্মহীন হয়েছেও অগনিত মানুষ। । কোভিড এর এই দিকটার বিষয়ে তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কোভিড র অন্য দিকটাও ক্রমশ মানুষের সামনে খুলে যাচ্ছে। যেটা হল কোভিড এ প্রচুর প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । তাও আবার শুধুমাত্র দেশের মধ্যে নয়,দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও, মানে যাকে বলা যায় রীতিমতো ইন্টারন্যাশনাল লাভ বা ক্রস বর্ডার লাভও বলা যায়।
ভালোবাসার টানে ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে আসা সীমা হায়দারের কাহিনী আমরা সবাই জানি। যখন পুরো দেশের সংবাদ মাধ্যম সীমা হায়দার আর শচীন কে নিয়ে ব্যাস্ত ছিল, তখন আরো একজন চুপিসাড়ে ভারত থেকে পাকিস্তানে পাড়ি দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। যদিও তার প্রস্তুতি প্রায় দু বছর আগে থেকে শুরু হয়ে গেছিলো।
কে এই অঞ্জু কুমার?
ইউপির কেলোর এলাকার একটি সাধারণ হিন্দু পরিবারের মেয়ে হলো অঞ্জু। 2007 সালে অরবিন্দ কুমার নামক একজন খ্রিষ্টান ব্যাক্তির সাথে লাভ ম্যারেজ হয় অঞ্জুর। বিয়ের পর অঞ্জু ও খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। এরপর ওরা রাজস্থানের আলোয়ার জেলার ভেবাডি তে সংসার শুরু করে। দুটি সন্তান হয় ওদের,একটি মেয়ে আর একটি ছেলে। এখন মেয়ের বয়স ১৫ বছর আর ছেলের বয়স ৬ বছর। বিয়ের কিছুদিন পরে ওদের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে যায়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে যায়। তাও বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে ওরা একসাথে থাকতো। অরবিন্দ আর অঞ্জু দুজনেই চাকরি করতো। ৩৫ বছর বয়সী অঞ্জু মোটরবাইক এর কোম্পানি হণ্ডাতে চাকরি করতো। সে কারণে বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য অঞ্জু তার ভাই এবং ভাইয়ের বউকে সঙ্গে রেখেছিল।
অঞ্জু আর নাসরুল্লাহ খানের পরিচয় কিভাবে?
এর মধ্যে ২০২০ সালে করোনা র কালো ছায়া পৃথিবীর বুকে নেমে আসে। গৃহবন্দি অবস্থায় অঞ্জু ও মোবাইলে সময় কাটাতে থাকে। এই সময় সোশ্যাল মিডিয়া প্রচুর মানুষের সময় কাটানোর উপায় হয়েছিল। এই ২০২০ সালেই ফেসবুকে তার সাথে পাকিস্তানের একজন ২৯ বছরের ছেলে নাসরুল্লাহ খানের সাথে আলাপ হয়। পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছাকাছি এলাকা খাইবার প্রাখতুন খা এর প্রায় আফগানিস্তানের সীমানার দিরবালা জেলাতে নাসরুল্লাহর বাড়ি। সে মেডিকেল ফিল্ডের কাজকর্মের সাথে জড়িত। ফেসবুকের আলাপ থেকে বন্ধুত্ব হলে তারা দুজন নিজেদের মধ্যে নাম্বার বিনিময় করে। তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তারপর ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলিং এ তারা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে তাদের প্রেমের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে, এবং দুজনের মধ্যে দেখা করার ইচ্ছে প্রবল হতে থাকে। নাসরুল্লাহ ভারতে আসার অনেক অসুবিধে ছিল। খাইবার পাখতুনের যে এলাকাতে সে বসবাস করত সেখানে তালিবানদের আধিপত্য রয়েছে, সে কারণে ভারতে আসার ভিসা সে কিছুতেই পেত না। তাই সে অঞ্জুকে অনুরোধ করে পাকিস্তান যাওয়ার জন্য। সেই থেকে শুরু হয় অঞ্জুর পাকিস্তানি পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি।
অঞ্জু কিভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করলো?
ইউপিতে বসবাসকারী ৩৫ বছর বয়সে অঞ্জু পাকিস্তানের নাসরুল্লাহর সাথে প্রেমের সম্পর্ক এতটাই গভীর হয় যে ঘর সংসার, সন্তান, আপন-পর, জাতি, ধর্ম এমন কি দেশ সে কিছুই দেখেনি। শুধুমাত্র প্রেম ভালোবাসার টানে ভারত থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
কিন্তু অঞ্জুর পাসপোর্ট ছিল না, কর্মসূত্রে সে দেশের বাইরে যেতে চায়, তাই তার পাসপোর্ট বানানো প্রয়োজন, এটাই সে তার স্বামী অরবিন্দ কে জানায়। পাসপোর্ট তৈরি হয়ে যায়, এরপর ভিসার আবেদন করে শুরু হয় অপেক্ষা। ভিসা আবেদনের কারণ হিসেবে দেখানো হয়, বিয়ে বাড়িতে যোগ দেওয়া। কিন্তু পাকিস্তান কিছুতেই অঞ্জু কুমার কে ভিসা দিচ্ছিল না। অন্যদিকে নাসরুল্লাহ পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের ফরেন মিনিস্ট্রি তে বারবার অনুরোধ করে, যাতে অঞ্জু কুমার কে ভিসা পেতে সাহায্য করা হয়। ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রায় দু বছর পরে পাকিস্তান অঞ্জু কুমার কে 30 দিনের ভিসা দেয় খাইবার পাখতুণ খা এর দীরবালাতে নাসুরল্লার বাড়ি যাওয়ার জন্য। গত বৃহস্পতিবার জুলাই মাসের কুড়ি তারিখে অঞ্জু বাড়ি থেকে এই বলে বের হয় যে সে জয়পুরে একজন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে। চাকরিতে ভীষণ প্রেসার যাচ্ছে, সে একটা সলো ট্রিপ করতে চায় একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। রাজস্থান থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে অমৃতসর, অমৃতসর থেকে ওবাঘা বর্ডার, ওয়াগা বর্ডার থেকে পাকিস্তানের লাহোরে সে পৌঁছয়। লাহোরে নাসরুল্লাহ তাকে রিসিভ করে , পরের দিন শুক্রবার সেখান থেকে তারা খাইবার পাকতুন এ দিরবালা ডিস্ট্রিকে নাসরুল্লাহর বাড়িতে পৌঁছয়।
অঞ্জু পাকিস্তান যাওয়ার বিষয়ে নাসরুল্লাহর কি বক্তব্য?
ফেসবুক থেকে গভীর প্রেম হওয়ার পরে ভিসা অ্যাপ্লাই পরে অঞ্জু। সৌভাগ্যবশত পাকিস্তান ভিসা দিয়ে দেয়। তারপর সে সোজা খাইবার পাখতুনে নিজের ভালোবাসার কাছে পাড়ি দেয়। কিছুদিনের মধ্যে ওদের মধ্যে অফিশিয়ালি এনগেজমেন্ট হবে বলে নাসরুল্লাহ জানিয়েছে। এছাড়াও সে জানিয়েছে, ভারতে অঞ্জু বিবাহিত ছিল, সেই অতীত নিয়ে নাসরুল্লাহর কোনরকম সমস্যা নেই। এনগেজমেন্ট এর পরে অঞ্জু আবার ভারতে আসবে, তখন সে তাকে আইনসম্মতভাবে বিয়ে করে লং টার্ম ভিসা নিয়ে বৈধভাবে পাকিস্তান নিয়ে যাবে। বিয়ের বিষয়ে এটাই হলো তাদের পরিকল্পনা। নাসরুল্লাহ আরো জানিয়েছে যে ব্যক্তিগত জীবনে তারা দুজন দুজনকে নিয়ে ভীষণ সুখী, তারা কোন অন্যায়ও করেনি অতএব তাদের ঘটনাকে যেন ব্যক্তিগত রাখতে দেওয়া হয়, কোনরকম সীমা হায়দারের ঘটনার মতো না করে দেওয়া হয়।
অঞ্জু নাসরুল্লাহর বিয়ের খবর কি সত্যি নাকি শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমের প্রচার?
২৫ শে জুলাই দুপুর দুটোর সময় পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম গুলোতে খবর চলতে থাকে যে অঞ্জু আর নাসরুল্লাহ র বিয়ে হয়ে গেছে। যখন অঞ্জু এবং নাসরুল্লাহ দুজনই সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল ওদের এই মুহূর্তে বিয়ে করার কোন পরিকল্পনা ছিল না, তাহলে হঠাৎ করে এরকম খবর এলো কেন? খবরে একটা বিয়ের প্রমাণপত্র দেখানো হচ্ছিল, আরো বলা হচ্ছিল বিয়ের প্রয়োজনে ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম ফতেমা রাখতে হয়েছে অঞ্জুকে। এছাড়াও বিয়ের নিয়ম অনুসারে সোনা দিয়ে অঞ্জুর সাথে নাসরুল্লাহর বিয়ে হয়েছে। ২৫ শে জুলাই সকাল সাড়ে এগারোটার সময় নাসিরুল্লাহ অঞ্জুর সাথে তার ফ্যামিলিকে নিয়ে, পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছে খাইবার পাখতুন খায়ে দীরবালা জেলার দীরবালা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে পৌঁছয়। কোর্টে কাজকর্ম সেরে তারা সংবাদ মাধ্যমের সাথে কোন রকম কথা না বলে সেখান থেকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম গুলোতে ওদের বিয়ের খবর চলতে থাকে। বীর এলাকার ডিআইজি নাসির মাহমুদ শক্তি সংবাদ মাধ্যমের কাছে এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান ওরা কোর্টে বিয়ে করার জন্যই এসেছিল এবং উকিল আর সাক্ষীর উপস্থিতিতে ওদের বিয়ে হয়। এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অঞ্জুর নতুন নাম ফতেমার বিষয়টাও তিনি নিশ্চিত করেন। পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে ওদেরকে ওদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয় এ বিষয়টাও তিনি নিশ্চিত করেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে। এরপরে সোশ্যাল মিডিয়াতে ওদের প্রি ওয়েডিং ফটোশুটের ভিডিও আসে, যেটা ওদের বিয়ের বিষয়টা নিশ্চিত করে। যদিও বিবাহের বিষয়টি অঞ্জু এবং নাসরুল্লাহ দুজনেই সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করছে।
অঞ্জু কুমার আর সীমা হায়দার এই দুটি ঘটনার মধ্যে মিল কতটা?
সীমা হায়দার পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছে আবার অন্যদিকে অঞ্জু ভারত থেকে পাকিস্তানের খাইবার প্পাখতুনে ভালোবাসার কারণে চলে গেছে
সিমা হায়দার শচীনের থেকে পাঁচ বছরের বড়, ওদিকে অঞ্জুর বয়স হল 35 বছর আর তার প্রেমিক নাসরুল্লাহর বয়স হলো ২৯ বছর। এখানেও ঠিক ছ বছরের পার্থক্য প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে।
সিমা হায়দার ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিল এবং সে চার সন্তানের মা কিন্তু শচীন অবিবাহিত, ওদিকে অঞ্জু বিবাহিত ও দুই সন্তানের মা কিন্তু নাসিরুল্লাহ অবিবাহিত।
সীমা হায়দার আর শচীনের সম্পর্ক শুরু হয় অনলাইনে পাবজি গেম খেলতে গিয়ে আর অঞ্জু নাসিরুল্লাহ র সম্পর্ক তৈরি হয় facebook থেকে।
সীমা যেভাবে শচীনের বাড়িতে উষ্ণ-অভ্যর্থনা পেয়েছে ঠিক সেই ভাবেই খাইবার পাখতুন অঞ্জু ও শ্বশুরবাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ির পাড়া প্রতিবেশীর তরফ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে
পার্থক্য শুধু দুটো বিষয়ে এবং একটা হল আসল বিষয় সেটা হলো সীমা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু অঞ্জু বৈধ ভিসা এবং পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানে গেছে। সীমা নিজের চারজন সন্তান সঙ্গে নিয়ে ভারতে এসেছে কিন্তু অঞ্জু নিজের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যায়নি। যাইহোক করোনা শুধু মৃত্যু কর্মহীনতা নিয়ে আসেনি, অনেক হৃদয়ে ভালোবাসার ও ফুল ফুটিয়েছে।