Alexa Seleno
@alexaseleno

   বীর বিক্রমে চাঁদে ভারতের “বিক্রম”

ভূমিকা 

             ভারতের মহাকাশ অভিযানের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হল। চন্দ্রযান থ্রি এর লঞ্চ আগেই হয়েছিল সাফল্যের সাথে। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান টু এইভাবে লঞ্চ করার প্রচেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তখন চন্দ্রযান টু এর সফট ল্যান্ডিং হতে পারেনি। এবার জুলাই মাসের ১৪  তারিখে দুপুর দুটো বেজে ৩৫ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরি কোটাতে সতীশ ধবন স্পেস সেন্টার থেকে একটা রকেটের মাধ্যমে চন্দ্রযান থ্রি বিক্রম এর লঞ্চ করা হয়েছিল। সেদিন পুরো পৃথিবী ভারতের সেই বিস্ময়ের, গর্বের মুহূর্তটি সংবাদমাধ্যমে দেখেছিল। চন্দ্রযান থ্রি এর গন্তব্য ছিল চাঁদের সাউথ পোলে। প্রায় দেড় মাস পরে ২৩ শে অগাস্ট সন্ধে ছটা বেজে চার মিনিটে চন্দ্রযান থ্রি সফলভাবে সফট লান্ডিং করতে পেরেছে। ল্যান্ডিং করার সময় ও পুরো পৃথিবী সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল।

  চন্দ্রযান থ্রি ল্যান্ডিংয়ের শেষ ১৫ মিনিট।।

   ২০২৩ সালের ২৩শে আগস্ট, আজ প্রতিটি ভারতবাসী গর্বিত। আজ পুরো দেশে তো অবশ্যই পুরো পৃথিবীতেও শুধুই ভারতের চন্দ্রযান থ্রি এর চর্চা। এই দিনে ভারতের চন্দ্রযান থ্রি চাঁদে সফট ল্যান্ডিং করে ইতিহাস তৈরি করল। যে কাজ আমেরিকা রাশিয়া চীন কেউই করতে পারেনি। যদিও এই দেশগুলির মিশন মুন প্রজেক্ট ভারতের অনেক বছর আগে শুরু হয়েছিল। কিছুদিন আগে রাশিয়ার চন্দ্রযান লুনা 25 নিজের অভিযানে অসফল ছিল। সেই একই ঘটনা যাতে চন্দ্রযান্ থ্রি বিক্রমের সাথে না ঘটে সে কারণে বিজ্ঞানীরা খুব সাবধানে ছিলেন।শেষ ৩০ মিনিটে চাঁদের শেষ কক্ষপথ থেকে যে ২৫ কিমি দূরত্ব ছিল সেটা চন্দ্রযান থ্রি সফলভাবে অতিক্রম করল। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ছিল। এমনিতেও ল্যান্ডিংয়ের সময়ের শেষ পনের মিনিট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেই সময় বিজ্ঞানীদের কোন রকম নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। এই সময়টাকে fear of 15 minutes ও বলা হয়। কোন রকম নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে বিজ্ঞানীরা যে গাণিতিক পরিভাষা চন্দ্রযানটি তে  আগে থেকে সেট করে রেখেছেন, সেই গাণিতিক পরিভাষার ওপর নির্ভর করে ল্যান্ড করে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় ল্যান্ডিং প্রক্রিয়ার শুরু হয়। পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে যখন লেন্ডার ভার্টিক্যাল ল্যান্ডিং করছিল তখন চাঁদের ভূমি থেকে চন্দ্রযান ৩ এর দূরত্ব মাত্র ৩ মিটার ছিল এবং সন্ধ্যে ছটা বেজে চার মিনিটে তৈরি হল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভারতের চন্দ্রযান থ্রি বিক্রম বীর বিক্রমে চাঁদের সাউথ পোলের মাটিতে সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করল। সেই সঙ্গে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের সাউথ পোলে সফট ল্যান্ডিং করার জন্য ভারতের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল।

   চন্দ্রযান থ্রির ল্যান্ডিংয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ।। 

 সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করে চন্দ্রযান থ্রি তার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছে, এবার চন্দ্রযানটি পরবর্তী ধাপের কাজগুলো শুরু করবে। ল্যান্ডিং  করার সময় রোভারের আশেপাশে প্রচন্ড ধুলো এবং ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি হয়েছে। এই ধুলো ও ধোঁয়ার আস্তরণ যখন সরে যাবে তখন লেন্ডার থেকে রোভার প্রজ্ঞান চাঁদের জমিতে নামবে এবং তথ্য সংগ্রহ করে ইসরোর বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠাবে। এছাড়াও ল্যান্ডার এবং রভার পরস্পর পরস্পরের প্রচুর ফটো তুলে পাঠাতে পারবে যেগুলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষনের কাজে সাহায্য করবে। প্রজ্ঞান হলো একটি সংস্কৃত শব্দ যার বাংলা মানে হলো বুদ্ধিমত্তা।

       কিছু তথ্য চাঁদের দুর্গম দক্ষিণ মেরুর বিষয়ে।।     

      পৃথিবীর মতো চাঁদের সাউথ পোলও ভীষণই ঠান্ডা। পৃথিবীর সাউথ পোল মানে আন্টার্টিকা যেটা হল পুরো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঠান্ডা এলাকা। তেমনি জানা গেছে চাঁদেরও সাউথ পোল পুরো অন্ধকারে ঢেকে থাকে কারণ এই এলাকায় সূর্যের রশ্মি পৌঁছয় না, আর এলাকার খুব ছোট অংশে সূর্যের কিরণ পৌঁছয়। চাঁদের যে এলাকায় সূর্যের রশ্মি পৌঁছয় সেখানকার তাপমাত্রা হলো ৫৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস আর যে এলাকায় তাপমাত্রা পৌঁছয় না মানে এই সাউথ পোলে সেখানকার তাপমাত্রা হলো -২৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এরকম একটা প্রচন্ড ঠান্ডা অন্ধকার জায়গায় যেখানে চাঁদের জমিটাও ঠিকমতো দেখা যায় না সেখানে চন্দ্রযান থ্রি অবশেষে সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করতে পেরেছে।

       চাঁদের সাউথ পোলে ভারত ঠিক কোন উদ্দেশ্যে।।

     সূর্যের রশ্মি চাঁদের সাউথ পোলে না পৌঁছানোর কারনে সেই জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার এবং প্রচন্ড ঠান্ডা। আগে চাঁদের সাউথ পোলে কোন দেশ কোন রকম অভিযান করেনি, তাও নাসার রিপোর্ট অনুসারে প্রচন্ড ঠান্ডা হওয়ার কারণে সাউথ পোলে বরফ আছে। আর যেখানে বরফ আছে সেখানে অবশ্যই জলও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য হল সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। যদি সেখানে সত্যিই বরফ বা জল পাওয়া যায় তাহলে সেটা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকারী হতে পারে। যেমন ওই জল থেকে ব্যবহারযোগ্য পানীয় জল তৈরি করা যেতে পারে তাছাড়া বরফ এর মধ্যে মেশিন ঠান্ডা করার কাজ খুব সহজেই হতে পারে। যদিও ওখানে প্রচন্ড অন্ধকার হওয়ার কারণে জমির কোন পরিষ্কার ফটো হয়তো পাওয়া যাবে না তবুও এই প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ভারত সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করে অসাধ্য সাধন করেছে।

       ঝুঁকিপূর্ণ চাঁদের সাউথ পোলে সফলভাবে ল্যান্ডিং।।

     পৃথিবীর নিজস্ব একটা উষ্ণতা এবং বায়ুমণ্ডল আছে। কিন্তু চাঁদের এই দুটোর কোনটাই নেই তাই চাঁদে ল্যান্ডিং করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে ল্যান্ডিং খুবই আস্তে আস্তে হতে পারে। কিন্তু চাঁদ বায়ু শূন্য হওয়ার কারণে ল্যান্ডিং তীব্র গতিতে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে লন্ডার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ও সম্ভাবনা থাকে। পৃথিবীর মতো মঙ্গলেও ল্যান্ডিং চাঁদের তুলনায় সহজভাবে হয়। ২০১৯ এর চন্দ্রযান 2 এর সফল সফট লেন্ডিং হতে পারেনি, কিন্তু এবার ইসরো সেই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছে। ২০২৩ সালের ২৩শে আগস্ট প্রায় সন্ধ্যে ৬টা বেজে ৪ মিনিটে চন্দ্রযান থ্রি, চাঁদের সাউথ পোলে সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করল।

      চন্দ্রযান থ্রি এর দীর্ঘ দেড় মাসের পথ চলা।।                        

        দীর্ঘ দেড় মাসের পথ চলার পর চন্দ্রযান থ্রি অবশেষে চাঁদের পৌঁছালো। তিন মিনিটের মধ্যে এই চন্দ্রযানটি প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার সফর করেছিল। মাত্র ১৬ মিনিটে এটা পৃথিবীর অক্ষে পৌঁছে গেছিলো। তারপরেও চাঁদে পৌঁছতে দেড় মাস সময় কেন লাগলো। প্রথমে চন্দ্রযানটিকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খেতে হবে। এইভাবে ঘুরপাক খেতে খেতে যখন এটা চাঁদের একেবারে কাছে পৌঁছে যাবে তখন এটা একটা ধাক্কার মাধ্যমে চাঁদের মধ্যে প্রবেশ করবে। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব তিন লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। তাছাড়া চন্দ্রযানটি পৃথিবী থেকে সোজাসুজি চাঁদে যেতে পারবে না, পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খেতেই এতটা সময় লাগবে। এমনিতেও এই এতটা পথ পাড়ি দিতে চন্দ্রযানটির শুধু জ্বালানি নয় তার সাথে অনেক উন্নত প্রযুক্তিরও প্রয়োজন। চন্দ্রযান থ্রি ইসরোর বৈজ্ঞানিকদের আশাহত করেনি।

           চন্দ্রযান থ্রি কি তার লক্ষ্যে সফল হতে পারবে।।

         চন্দ্রযান থ্রী এর মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি।প্রথম লক্ষ্য ছিল লেন্ডার সুরক্ষিতভাবে চাঁদের জমিতে সফট ল্যান্ডিং করতে পারে এবং এটি সফলভাবে করতে পেরেছে।দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো একবার সফলভাবে চাঁদের জমিতে সফট ল্যান্ডিং হয়ে গেলে রোভার যেন চাঁদের জমিতে ঠিকমতো চলাচল করতে পারে। যদি এটা সম্ভব হয় তাহলে  বৈজ্ঞানিক পরীক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ এবং তথ্য পাওয়া যাবে। আর তৃতীয় লক্ষ্য হলো চাঁদ থেকে ঠিকমতো প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা, ফটো তুলে পাঠানো আর চাঁদে থাকা খনিজের নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানো যাতে সেগুলো দিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হওয়াতে আশা করা হচ্ছে চন্দ্রযান থ্রী বাকি লক্ষ্য গুলো সফল্ভাবে ও পূরণ করতে পারবে। 

          ভারতের জন্য চন্দ্রযান থ্রির সাফল্যের গুরুত্ব।।

            ১৯৫টি দেশ আছে পুরো পৃথিবীতে। তার মধ্যে মাত্র চারটি দেশ চাঁদে অভিযান করতে পেরেছে, রাশিয়া, আমেরিকা, চীন এবং ভারত। এখনো পর্যন্ত চাঁদের সাউথ পোলে পৃথিবীর কোন দেশ অভিযান করেনি। ভারতই হলো প্রথম দেশ যে চাঁদের সাউথ পোলে সফল ভাবে সফট ল্যান্ডিং করলো। ঠিক এই কারণেই চন্দ্রযান থ্রি অভিযানটি ভারতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এর আগে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন এই তিনটি দেশ চাঁদে অভিযান করেছে আর ভারত হলো চতুর্থ দেশ যে চাঁদে অভিযান করছে। কিন্তু চাঁদের সাউথ পোলে ভারতই হবে প্রথম দেশ যে অভিযান করল। এমনিতেও মঙ্গল গ্রহের তুলনাতে চাঁদে সফট ল্যান্ডিং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর চাঁদের সাউথ পোলে সূর্যের রশ্মি না পৌঁছানোর কারণে একেবারেই অন্ধকার। ভারতই হল প্রথম দেশ যে প্রথম বার চাঁদের সাউথ পোলে সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করলো।তাছাড়াও চাঁদের জমিতে কি ধরনের রাসায়নিক পাওয়া যেতে পারে, চাঁদের জল আর মাটি কেমন এইসব ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।চাঁদের জমিতে যদি সোনা, প্ল্যাটিনাম, ইউরেনিয়াম এর মত বহুমূল্য ধাতু পাওয়া যায় তাহলে সেটা ভারতের জন্য ভীষণই লাভজনক হতে পারে। মহাকাশ অভিযানে ভারতের এই সাফল্য এই বিষয়ে চীনের একতরফা এগোনোতে বাধার সৃষ্টি করবে। এই সমস্ত কারণে চন্দ্রযান থ্রি এর অভিযান ভারতের জন্য ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.