ভূমিকা
ভারতের মহাকাশ অভিযানের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হল। চন্দ্রযান থ্রি এর লঞ্চ হলো সাফল্যের সাথে। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান টু এইভাবে লঞ্চ করার প্রচেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তখন চন্দ্রযান টু এর সফট ল্যান্ডিং হতে পারেনি। কিন্তু এবার জুলাই মাসের ১৪ তারিখে দুপুর দুটো বেজে ৩৫ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরি কোটাতে সতীশ ধবন স্পেস সেন্টার থেকে একটা রকেটের মাধ্যমে চন্দ্রযান থ্রি লঞ্চ করা হয়েছে। পুরো দুনিয়া ভারতের সেই বিস্ময়ের, গর্বের মুহূর্তটি খবরের চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে দেখেছে। চন্দ্রযান থ্রি এর গন্তব্য হলো চাঁদের সাউথ পোলে, সেখানে পৌঁছতে এই চন্দ্রযানটির প্রায় দেড় মাস সময় লাগবে।
চাঁদের সাউথ পোলে কি আছে?
পৃথিবীর মতো চাঁদের সাউথ পোলও ভীষণই ঠান্ডা। পৃথিবীর সাউথ পোল মানে আন্টার্টিকা যেটা হল পুরো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঠান্ডা এলাকা। তেমনি জানা গেছে চাঁদেরও সাউথ পোল পুরো অন্ধকারে ঢেকে থাকে কারণ এই এলাকায় সূর্যের রশ্মি পৌঁছয় না, আর এলাকার খুব ছোট অংশে সূর্যের কিরণ পৌঁছয়। চাঁদের যে এলাকায় সূর্যের রশ্মি পৌঁছয় সেখানকার তাপমাত্রা হলো ৫৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস আর যে এলাকায় তাপমাত্রা পৌঁছয় না মানে এই সাউথ পোলে সেখানকার তাপমাত্রা হলো -২৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন এটাই দেখার যে এরকম একটা প্রচন্ড ঠান্ডা অন্ধকার জায়গায় যেখানে চাঁদের জমিটাও দেখা যাবে না, সেখানে চন্দ্রযান থ্রী সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করতে পারে কিনা।
চাঁদের সাউথ পোলে অভিযানের কারণ কি?
যেহেতু সূর্যের রশ্মি চাঁদের সাউথ পোলে পৌঁছয় না সেই কারণে জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার এবং প্রচন্ড ঠান্ডা। যদিও এর আগে চাঁদের সাউথ পোলে কোন অভিযান হয়নি, তাও নাসার রিপোর্ট অনুসারে প্রচন্ড ঠান্ডা হওয়ার কারণে সাউথ পোলে বরফ আছে। আর যেখানে বরফ আছে সেখানে অবশ্যই জলও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য হল সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। যদি সেখানে সত্যিই বরফ বা জল পাওয়া যায় তাহলে সেটা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকারী হতে পারে। যেমন ওই জল থেকে ব্যবহারযোগ্য পানীয় জল তৈরি করা যেতে পারে তাছাড়া বরফ এর মধ্যে মেশিন ঠান্ডা করার কাজ খুব সহজেই হতে পারে। যদিও ওখানে প্রচন্ড অন্ধকার হওয়ার কারণে জমির কোন পরিষ্কার ফটো হয়তো পাওয়া যাবে না তবুও এই প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ভারত অসাধ্য সাধন করার চেষ্টা করছে।
চাঁদে ল্যান্ডিং এত ঝুঁকিপূর্ণ কেন?
চাঁদে পৃথিবীর মত বায়ুমণ্ডল নেই। তাই চাঁদে ল্যান্ডিং করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে ল্যান্ডিং খুবই আস্তে আস্তে হতে পারে। কিন্তু চাঁদ বায়ু শূন্য হওয়ার কারণে ল্যান্ডিং তীব্র গতিতে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে লন্ডার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ও সম্ভাবনা থাকে। পৃথিবীর মতো মঙ্গলেও ল্যান্ডিং চাঁদের তুলনায় সহজভাবে হয়।
চাঁদে পৌঁছতে চন্দ্রযান থ্রি এর এত সময় কেন লাগবে?
তিন মিনিটের মধ্যে এই চন্দ্রযানটি প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার সফর করেছিল। মাত্র ১৬ মিনিটে এটা পৃথিবীর অক্ষে পৌঁছে গেছিলো। তারপরেও চাঁদে পৌঁছতে দেড় মাস সময় কেন লাগবে। তার কারণ হলো চন্দ্রযান টি সোজা চাঁদে যেতে পারবে না। প্রথমে চন্দ্রযানটিকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খেতে হবে। এইভাবে ঘুরপাক খেতে খেতে যখন এটা চাঁদের একেবারে কাছে পৌঁছে যাবে তখন এটা একটা ধাক্কার মাধ্যমে চাঁদের মধ্যে প্রবেশ করবে। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব তিন লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। তাছাড়া চন্দ্রযানটি পৃথিবী থেকে সোজাসুজি চাঁদে যেতে পারবে না, পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খেতেই এতটা সময় লাগবে। এমনিতেও এই এতটা পথ পাড়ি দিতে চন্দ্রযানটির শুধু জ্বালানি নয় তার সাথে অনেক উন্নত প্রযুক্তিরও প্রয়োজন। আশা করা হচ্ছে ২৩শে আগস্ট বা ২৪ শে আগস্ট বিকেল ৫ টা বেজে ৪৭ মিনিটে এটা চাঁদে ল্যান্ড করবে।
চন্দ্রযান থ্রি এর লক্ষ্য কি?
চন্দ্রযান 3 এর এই মুহূর্তে মূল লক্ষ্য হলো তিনটি।
প্রথম লক্ষ্য হলো লান্ডার যেন সুরক্ষিতভাবে চাঁদের জমিতে সফট ল্যান্ডিং করতে পারে। এই একটি বিষয়ের উপরই অভিযানটির বাকি অংশের সাফল্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে।
দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো একবার সফলভাবে চাঁদের জমিতে সফট ল্যান্ডিং হয়ে গেলে রোভার যেন চাঁদের জমিতে ঠিকমতো চলাচল করতে পারে। যদি এটা সম্ভব হয় তাহলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ এবং তথ্য পাওয়া যাবে।
আর তৃতীয় লক্ষ্য হলো চাঁদ থেকে ঠিকমতো প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা, ফটো তুলে পাঠানো আর চাঁদে থাকা খনিজের নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানো যাতে সেগুলো দিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়।
রোভার কি?
যখন পৃথিবী থেকে রকেটের মাধ্যমে লেন্ডার পাঠানো হয়, সেটি বিশাল আকৃতির হয়। কিন্তু চাঁদে পৌঁছানোর আগে লেন্ডারটির থেকে বাকি অংশ আলাদা হয়ে যায়। চাঁদে একটা খুব ছোট্ট আকৃতির বস্তু পৌঁছায় যেটা খুব সফট ভাবে ল্যান্ড করতে পারে আর ওই ল্যান্ডারের মধ্যে একটা রোভার থাকে। রোভার দেখতে হল একটা ছোট গাড়ির মত যার মধ্যে ক্যামেরা থাকে কিন্তু এটি রোবটের মত কাজকর্ম করে, যেমন ফটো তুলে পাঠানো, চাঁদে মজুদ থাকা রাসায়নিক, ধাতু আর খনিজের নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানো এইসব। এক কথায় বলতে গেলে রোভারের কাজ হল তথ্য আর নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য।
সফট ল্যান্ডিং কাকে বলে?
যেকোনো মহাকাশযানের ল্যান্ডিং দুভাবে করানো যায়, একটা হল সফট ল্যান্ডিং আর অন্যটা হলো হার্ড ল্যান্ডিং। সফট ল্যান্ডিং এর ক্ষেত্রে মহাকাশযান্ টির গতি কমিয়ে খুব আস্তে আস্তে ল্যান্ডিং করানো হয়। এই ক্ষেত্রে সফলভাবে ল্যান্ডিং হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর হার্ড ল্যান্ডিং হলো দ্রুত গতিতে লেন্ডারকে ল্যান্ড করানো, এই ক্ষেত্রে সফলভাবে লেন্ডিং হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। চাঁদ বায়ুশূন্য হওয়ার কারণে চাঁদে হার্ড ল্যান্ডিং এর পরিবর্তে সফট ল্যান্ডিং করানো হয়।
ভারতের জন্য চন্দ্রযান থ্রির গুরুত্ব কতটা?
ভারতের মতো অন্যান্য দেশ যেমন রাশিয়া, আমেরিকা, চীন এরাও চাঁদে অভিযান করেছে। কিন্তু চন্দ্রযান থ্রি ভারতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এখনো পর্যন্ত চাঁদের সাউথ পোলে দুনিয়ার কোন দেশ অভিযান করেনি। যদি চন্দ্রযানটি চাঁদের সাউথ পোলে সফল ভাবে সফট ল্যান্ডিং করতে পারে তাহলে ভারতই হবে প্রথম দেশ যার চাঁদের সাউথ পোলে অভিযানে সফল হবে। ঠিক এই কারণেই চন্দ্রযান থ্রি অভিযানটি ভারতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এর আগে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন এই তিনটি দেশ চাঁদে অভিযান করেছে আর ভারত হলো চতুর্থ দেশ যে চাঁদে অভিযান করছে। কিন্তু চাঁদের সাউথ পোলে ভারতই হবে প্রথম দেশ যে অভিযান করল। এমনিতেও মঙ্গল গ্রহের তুলনাতে চাঁদে সফট ল্যান্ডিং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর চাঁদের সাউথ পোলে সূর্যের রশ্মি না পৌঁছানোর কারণে একেবারেই অন্ধকার। ভারতই প্রথম দেশ যে প্রথম বার চাঁদের সাউথ পোলে সফট ল্যান্ডিং করার এই প্রচেষ্টা করছে।
তাছাড়াও পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ যার বিষয়ে সাউথ পোল থেকে আমরা অনেক নতুন তথ্য পেতে পারি যা আগে কখনো জানা যায়নি। চাঁদের জমিতে কি ধরনের রাসায়নিক পাওয়া যেতে পারে, চাঁদের জল আর মাটি কেমন এইসব ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চাঁদের জমিতে সোনা, প্ল্যাটিনাম, ইউরেনিয়াম এর মত বহুমূল্য ধাতু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হচ্ছে। যেটা ভারতের জন্য ভীষণই লাভজনক হতে পারে।
এছাড়াও ভারত চীনকে মহাকাশ অভিযানে একতরফা এগিয়ে যেতে দিতে চায় না। এই সমস্ত কারণে চন্দ্রযান থ্রি এর অভিযান ভারতের জন্য ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ।