ভূমিকা
সময়ের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে সমাজ, সমাজের রীতিনীতি, আদব কায়দা, নিয়ম-কানুন এরও পরিবর্তন হচ্ছে। আগে যেমন অন্যায় অবিচার শুধুমাত্র মহিলাদের উপর করা হতো, এই সময়ে সেটা পুরুষদের উপরও হচ্ছে। কাজের জায়গায়, পারিবারিক কারণে, বৈবাহিক জীবনে আরও অনেক ভাবে পুরুষ অন্যায়ের শিকার হচ্ছে এবং কখনো কখনো সে কারণে পুরুষরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। তো সেই কারণে অত্যাচারিত পুরুষরা যাতে নিজের জন্য লড়াই করে সুবিচার পেতে পারে, তার জন্য একটা গাইডলাইন অবশ্যই থাকা উচিত, এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টে একটা পি আই এল ফাইল করা হয়েছিল। তার সাথে এটাও বলা হয়েছে ওই পিআইএল এ যে, এই পরিবর্তিত সময়ে দাঁড়িয়ে ন্যাশনাল কমিশন ফর মেন গঠন করাটা ভীষণ জরুরি।
ন্যাশনাল কমিশন ফর মেন গঠনের প্রস্তাবটি কার ছিল?
আজ থেকে কিছুদিন আগে যখন সুপ্রিম কোর্টের ছুটি চলছিল সেই সময় একটা পি আই এফ এল ফাইল করা হয়েছিল, যেটার শুনানি জুলাই মাসে ৩ তারিখে হওয়ার ছিল। এরকম পিআইএল ফাইল করার পেছনে কারণটা কি?
মহেশ কুমার তিওয়ারি নামক একজন ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টে এই পি আই এল ফাইল করে। সম্প্রতি আলোক মরিয়া আর জ্যোতি মরিয়ার বিবাহিত জীবনের অশান্তি যেভাবে সারা দেশের চর্চার বিষয় হয়েছে, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই পি আই এল টি ফাইল করা হয়েছে।
আলোক মরিয়া আর জ্যোতি মরিয়ার ঘটনাটি কি?
প্রয়াগরাজের আলোর মরিয়ার সাথে বেনারসের চিরই গ্রামের জ্যোতির ২০১০ সালে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর জ্যোতির পড়াশুনা করার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে আলোক জ্যোতির পড়াশোনা কে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দেবার জন্য সব রকম সাপোর্ট করে। যমজ দুটি কন্যা সন্তানকে নিয়ে আলোক আর জ্যোতি সুখেই সংসার করছিল। ২০১৫ সালে জ্যোতি পিসিএস পরীক্ষায় পাস করে এবং ট্রেনিং শেষ করে ২০১৬ তে এস ডি এম পদে চাকরিতে যোগদান করে। কর্মসূত্রে জ্যোতিকে দুই সন্তানের সাথে মাকে নিয়ে বাইরে থাকতো আর আলোক প্রয়োগরাজে নিজের গ্রামের বাড়িতে থাকতো। বদলির চাকরি এমনিতেও জ্যোতি আর আলোকে আলাদা করে দিয়েছিল।২০২০ সাল থেকে তাদের সম্পর্ক একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে। আলোকের অভিযোগ জ্যোতি এস ডি এম হওয়ার পরে তার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। তাছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তিরও প্রবেশ ঘটেছে। আর জ্যোতির তরফে অভিযোগ হল আলোক পঞ্চায়েত রাজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী হয়েও নিজেকে অফিসার পরিচয় দিয়ে, মিথ্যে বলে জ্যোতিকে বিয়ে করেছে। তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বৈবাহিক জীবনের অশান্তি কিছু whatsapp চ্যাট, অডিও আর ভিডিও ক্লিপ এর সাথে আলোক মিডিয়ার সামনে নিয়ে আসে। তারপর থেকেই ব্যাপারটা বিষয়টা সমস্ত দেশের চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
ন্যাশনাল কমিশন ফর মেন গঠনের প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের কী বক্তব্য?
মহেশ কুমার তিওয়ারির মনে হয়েছে যেভাবে আলোক মরিয়া তার স্ত্রী জ্যোতি মরিয়াকে সব রকম সাপোর্ট দিয়ে পড়াশুনা করে এস ডি এম হতে সাহায্য করার পর যে অন্যায় অবিচারের শিকার হয়েছে সে রকম আমাদের সমাজে আরও অনেক পুরুষ আছে যারা এরকমই অন্যায়ের শিকার হচ্ছে। তারা যাতে সুবিচার পেতে পারে, তাই তাদের কথা ভেবেই এই পি আই এল টি ফাইল করেছেন তিনি। এই পি আই এলে পুরুষদের ওপর অন্যায় অত্যাচারের বিষয়টা খুব গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে তার সাপোর্টে কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে।
যেমন ২০২১- ২০২২ সালে আমাদের দেশে ৮১ হাজার এরও বেশি পুরুষ আত্মহত্যা করেছে আর সেই জায়গায় মহিলাদের আত্মহত্যার সংখ্যা হচ্ছে ২৮০০০। ওনার মতে এই যে এত পুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তার বেশিরভাগ কারণটাই হল বিবাহিত জীবনে অশান্তি।
তো এই পিআইএল সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারপতির সামনে লিস্ট করা হয়েছিল, জাস্টিস সুরিয়া কান্ত আর জাস্টিস দীপঙ্কর দত্তা। পি আই এল লিস্ট তো হয়ে গেছিল কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে এটাকে রিজেক্ট করা হয। সুপ্রিম কোর্টের মতে ন্যাশনাল কমিশন ফর মেন বানানোর কোন প্রয়োজন নেই। যে সব পুরুষদের সমস্যা হচ্ছে, যে কারণে তারা সুইসাইড করছে সেটা বিবাহিত জীবনের কারণে হোক বা অন্য কোন সমস্যার কারণে হোক, তার সমাধানের জন্য আরো অনেক পথ খোলা আছে। তাছাড়া যদি কোন পুরুষ সুইসাইড করে তাহলে তার পরিবার গিয়ে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট এটাও বলছেন যে যদি বলা হচ্ছে ভারতে যত পুরুষ সুইসাইড করছে বা অত্যাচারিত হচ্ছে সেটা শুধুমাত্র তার স্ত্রীর কারণে তাহলে এটা একটা একেবারেই একতরফা গল্প হয়ে যাবে। আমাদের দেশে এমন অনেক মহিলা আছেন যারা বিয়ের এক দুই বা তিন বছরের মধ্যে সুইসাইড করছে। অতএব যদি কোন পুরুষ অত্যাচারিত হচ্ছে তাহলে সে আইনি ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে পারে।
এছাড়া পিআইএলে আরো বলা হয়েছে যে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন এর উচিত একটা গাইডলাইন তৈরি করা, যাতে পুরুষ মানুষরা অত্যাচারিত হলে ন্যায় বিচার পেতে পারেন।
মিনিস্ট্রি অফ হোম অ্যাফেয়ার এর ও তরফ থেকে একটা নির্দেশ থাকা উচিত যাতে কোন অত্যাচারিত পুরুষ থানায় গিয়ে অভিযোগ করলে সেই অভিযোগটা যেন নেওয়া হয়, এই বিষয়টাও পি আই এল এ উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এই সব বিষয়ে পুরুষ যদি কখনো থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন থানা থেকে সেই অভিযোগটা নেওয়াই হয় না এটা বলে যে কোন পুরুষকে তার স্ত্রী এই ধরনের কোন রকম অত্যাচার করতেই পারে না। মহেশ কুমার তিওয়ারি পি আই এল এ এই বিষয়টাও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
তার সাথে ল কমিশন অফ ইন্ডিয়া এর ও একটা ডেটা বানানো উচিত যাতে ভারতে কত পুরুষ বছরে আত্মহত্যা করছে যাদের সাথে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হচ্ছে এবং সেই রিপোর্ট সরকারকে দেওয়া হোক যাতে সরকার পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
ভারতে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ল, ডাওরি প্রহিবিশন ল, সেক্সচুয়াল হেরাসমেন্ট অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস অ্যাক্ট রেপ অথবা সেক্সচুয়াল অফেন্স ল, এই সমস্ত আইনের ধারা শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য আছে। এই ধরনের একটাও আইন কিন্তু পুরুষদের জন্য নেই। কিন্তু এমন নয় যে সমাজে পুরুষরা অত্যাচারিত হচ্ছে না। কাজের জায়গায় মানসিক চাপ, পারিবারিক চাপ, বিবাহিত জীবনের অশান্তি এসব কিছু পুরুষদের জীবনেও থাকে। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকা উচিত বলে মনে করা হচ্ছে এই মহেশ কুমার তিওয়ারির করা পি আই এল এ।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে ভারতে ন্যাশনাল কমিশন ফর মেন গঠন এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। যদি কোন পুরুষ অন্যায় অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন তাহলে তিনি অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।
আলোক মরিয়া আর জ্যোতি মরিয়া ঘটনাতে জনসাধারণের কি প্রতিক্রিয়া?
আলোক vs জ্যোতি মরিয়া কেসের প্রতিক্রিয়া ভারতের জনসাধারণের উপর মারাত্মক ভাবে পড়েছে। বিহারের একটা কোচিং যেটা খান স্যারের কোচিং নামে বিখ্যাত সেই কোচিং থেকে ৯৩ ছাত্রীর কোচিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাদের পরিবারের তরফ থেকে। এই ছাত্রীরা বিহার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জ্যোতি মরিয়ার ঘটনা জানার পরে ৯৩ জন ছাত্রীর স্বামীরা তাদের পড়াশোনা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় এই বলে যে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার আর কোনো প্রয়োজন নেই। খান সার অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যে সবাই একই রকম নয়, ওনারা হয়তো যদি মরিয়ার মত কিছুই করবে না। অন্য আরেকটা ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সামনে এসেছে যেটা হলো একজন মহিলা সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার স্বামী ও বলে আর সরকারি চাকরি পরীক্ষা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মহিলা যদিও বা সরকারি চাকরি পরীক্ষায় সফল হয়ে কোন অফিসার পদে চাকরি পেয়ে যায় কিন্তু স্বামী আর কোন আলোক মরিয়া হতে চায় না। তো সেই মহিলা তার স্বামীকে অনেক বোঝানোর পরে যখন কোন ফল হয়নি তখন সে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পুলিশ স্টেশনে ওই মহিলার স্বামীকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে সবাই জ্যোতি মরিয়া হবে এরকম কোন কথা নেই। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে ও ব্যাপারটা এইভাবেই ছড়ানো হচ্ছে যে মেয়েকে পড়াও বৌ কে নয়।