ভুমিকা
এই বিচিত্র দুনিয়াতে মানুষের শখও বিচিত্র। কেউ চাঁদে জমি কিনছে তো কেউ মহাকাশে ভ্রমণার্থী হিসেবে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কেউ কেউ তো মঙ্গল গ্রহে বসবাসও করতে চায়।বলা হয় একবার মহাকাশে ঘুরে আসার খরচ প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা এবং সেই সফর খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাও মহাকাশে ভ্রমণার্থী হিসেবে যাওয়ার জন্য মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।আবার কেউ জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছে। মানুষের নানাধরনের বিচিত্র শখ পূরণ করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির সাথে এগিয়ে আসছে বিভিন্ন সংস্থাও।
কি প্রয়োজনে বানানো হয়েছিল ডুবোজাহাজ টাইটান?
ওসেন গেট নামক একটি সংস্থা একটি টাইটান নামক ডুবোজাহাজ বানিয়েছিল এরকমই একটি বিচিত্র শখ পূরণ করার জন্য। গভীর সমুদ্রে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য এই ডুবোজাহাজ টাইটানের ব্যবহার করা হতো। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখানোর কাজ করত বলে এই ডুবোজাহাজটির নাম টাইটানিকের সাথে মিলিয়ে টাইটান রাখা হয়েছিল। ভীষণই ব্যয়বহুল ঝুঁকিপূর্ণ অদ্ভুত শখ হলো এই ভাঙ্গা জাহাজ টাইটানিককে দেখতে যাওয়া কিন্তু এই দুনিয়ায় প্রচুর মানুষের এই বিচিত্র শখ আছে। ৮ দিনের এই অভিযানটির জন্য জনপ্রতি খরচ ছিল প্রায় 2 কোটি টাকারও বেশি। গভীর সমুদ্রের তলায় টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের চারপাশ থেকে ঘুরিয়ে দেখানোর কাজ করত ওসেন গেট সংস্থাটি। তাই টাইটান নামক ডুবোজাহাজটির মালিকানা এই ওসেন গেট সংস্থার। ২০২১ সালে এই সংস্থাটি এই ডুবোজাহাজ টাইটানের সাহায্যে এরকমই একটি সফল অভিযান করেছিল। ক্যাপসুলের মতো দেখতে এই ডুবোজাহাজটি একটি গাড়ির সাইজের ছিল। লম্বায় এটি ৭ মিটার ছিল,৫ জন ব্যাক্তির জন্য এই ডুবোজাহাজ টি তৈরি করা হয়েছিল। সামনের দৃশ্য দেখার জন্য আর ফটো তোলার জন্য এই ডুবোজাহাজটির সামনে কাঁচ লাগানো ছিল। একটি ছোট টয়লেটের সাথে কিছু খাবার-দাবার রাখার জায়গা আর বসার জায়গা ছিল এই ডুবো জাহাজটিতে। একবার সমুদ্রের তলা থেকে ফেরত আসতে প্রায় আট ঘন্টা সময় লাগত। সেই হিসেবে পাঁচ জন ব্যাক্তির জন্য প্রায় ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন মজুদ ছিল এই ডুবোজাহাজটিতে যেটা প্রয়োজনের থেকে কিছুটা বেশী।
কারা ছিলেন ডুবোজাহাজ টাইটানের আরোহী?
বিচিত্র শখের চারজন ব্যক্তি ডুবোজাহাজ টাইটানের আরোহী ছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের বিচিত্র শখ পূরণ করার জন্য মাত্র ৮ দিনে দু কোটিরও বেশি টাকা খরচ কেবল ধনকুবের রাই করতে পারে। এদের মধ্যে একজন হলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ধনকুবের ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ যিনি বৃটেনে বসবাস করতেন। শাহজাদা দাউদ তার ১৯ বছরের ছেলে সুলেমান দাউদের সঙ্গে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন। এছাড়া ছিলেন ব্রিটেনের আরেকজন ধনকুবের ব্যবসায়ী যার নাম হাসিম হার্ডি। আর ছিলেন ওসেন গেট কোম্পানির সি ই ও এবং এই ডুবোজাহাজ টাইটানের ক্যাপ্টেন স্টকটন রাস। আর ছিলেন একজন ফ্রান্সের নাগরিক পল হেনরি যিনি এই ধরনের অভিযান এর আগে অনেক করেছেন এবং সব সময় ভীষণই আগ্রহী থাকতেন এই ধরনের অভিযান করার জন্য ।এই পাঁচজনকে নিয়ে ডুবোজাহার টাইটানটি কানাডার নিউ ফাউন্ড ল্যান্ড বন্দর থেকে টাইটানিকের দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সমুদ্রের ৪০০০ মিটার জলের তলায় গিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ চারপাশ থেকে ঘুরে দেখা আর ফটো তোলা, এই ছিল সফরসূচি। ৮ দিনের সফর শেষে পুরো দলটাকে নিয়ে ২৬ শে জুন ফেরত আসার পরিকল্পনা ছিল এই ডুবোজাহাজের।
ডুবোজাহাজ টাইটান কিভাবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল?
সফরের শুরু হয়েছিল ১৬ ই জুন কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড বন্দর থেকে। কানাডার এই বন্দর থেকে জাহাজে করে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে মাঝ সমুদ্রে যেখানে জলের তলায় টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সেখান পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল। এই সব কিছু করতে প্রায় দুদিন লেগে যায় এরপর তারিখ আসে ১৮ই জুনের। ঐদিন ভারতীয় সময় হিসেবে বিকেল সাড়ে পাঁচটা আর কানাডার সময় হিসেবে সকাল আটটার সময় যোগাযোগ স্থাপনকারী জাহাজ থেকে ডুবোজাহাজ টাইটান কে জলে নামানো হয়। এই ডুবোজাহাজটি এরকম প্রযুক্তিতে তৈরি যে এটাকে ভেতর থেকে খোলার কোনো রকম ব্যবস্থা নেই। যাত্রীরা ভিতরে বসে যাওয়ার পরে বাইরে থেকে এটাকে সম্পূর্ণভাবেই লক করে দেওয়া হয়, কিন্তু এটা সমুদ্রের উপরে ভেসে থাকা যোগাযোগ স্থাপনকারী জাহাজ আর কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগে থাকে। সমুদ্রের জলের তলায় ভাঙ্গা টাইটানিকের কাছ থেকে একবার ঘুরে ওপরে উঠে আসতে প্রায় আট ঘন্টা সময় লাগে এই ডুবোজাহাজ টির। সমুদ্রের ওপর থেকে জলের তলায় ভাঙা টাইটানিক পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় দু ঘন্টা সময় লাগে। তারপর ভাঙা জাহাজ টাইটানিককে চারপাশ থেকে ঘুরে দেখতে, ফটো তুলতে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে। সবশেষে সমুদ্রের তলা থেকে উপরে উঠে আসতে আবার দু’ঘণ্টা সময় লাগে। ডুবোজাহাজ টাইটানকে জলে নামানোর পরে প্রায় এক ঘন্টা ৪৫ মিনিট সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। সকাল নটা বেজে ৪৫ মিনিটে ওপরের জলে ভেসে থাকা যোগাযোগ স্থাপনকারী জাহাজটির সাথে ডুবোজাহাজ টাইটানের সম্পূর্ণ রূপে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ঘটে ।কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার, অনেক বার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ঘটে আবার যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। কিন্তু এখানে চিন্তার কারণ ঘটছিল যে ডুবোজাহাজটির সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ স্থাপন করা যাচ্ছিল না। এরপর কিছুটা সময় ধরে খতিয়ে দেখা হয় কোনরকম যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ডুবোজাহার টির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কিনা। যারা ডুবোজাহাজের ভিতরে রয়েছে তারা যোগাযোগ স্থাপনকারী জাহাজটির থেকে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর তো কোন ভাবেই নিজেদের বাঁচাতে কিছু করতে পারবে না। প্রায় ৮ ঘণ্টা পরে মানে ডুবোজাহাজটি জলের তলা থেকে উঠে আসার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পরেও যখন ওপরে উঠে এল না তখন ইউএস কোস্ট গার্ড কে এলার্ট করা হয়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রায় আট ঘন্টা পরে ইউ এস কোস্ট গার্ড গভীর সমুদ্রে তাদের তল্লাশি শুরু করে, পরে ওদের সাথে কানাডা কোস্ট গার্ড ও যোগ দেয়।
ডুবোজাহাজ টাইটানকে কিভাবে খুঁজে পাওয়া গেল?
১৮ জুন যে সময় ডুবোজাহাজ টাইটানের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল যোগাযোগ স্থাপনকারী জাহাজটির সাথে, সেই সময় ইউ এস কোস্ট গার্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। যদিও সেই সময় তারা জানতো না এই বিস্ফোরণটি কি কারণে হয়েছিল এবং তারা সেটা নিয়ে কোন রকম খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। কিন্তু ইনফরমেশন পাওয়ার পরে ইউএস এবং কানাডা কোর্স গার্ড তল্লাশি অভিযান চালায় এবং সেটা তারা সেই রাতেই শুরু করে। যদিও সেই রাতে ডুবোজাহাজ টাইটানের কোন রকম খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। ডুবোজাহাজটি তল্লাশি চালানোর সময় ইউ এস আর কানাডার তল্লাশি কারী দলটিকে অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। একে তো আবহাওয়া প্রচন্ড খারাপ ছিল তার ওপর এই ডুবোজাহাজ টাইটানটির রং হলো সাদা। জলের তলায় গভীর সমুদ্রে সাদা রঙের কোন জিনিস খুঁজে পাওয়াটা ভীষণই সমস্যার কারণ সমুদ্রের তলার অনেক কিছুই রং হয় সাদা। তার ওপর কোনো রকম যোগাযোগ মাধ্যম ও কাজ করছে না। এই অবস্থায় সাদা রংয়ের ডুবোজাহাজ টাইটান কে খুঁজে পাওয়াটা বেশ কঠিন কাজ। এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তল্লাশি অভিযান চলতে থাকে। এরপর ২২ শে জুন টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের পাশে ডুবোজাহাজ টাইটানের সামনের এবং পেছনের দুটো ভাঙ্গা টুকরো তল্লাশি কারী দলটি দেখতে পায়। এরপর ওসেন গেট সংস্থাটি একটি কনফারেন্সের আয়োজন করে এবং তাতে জানায় যে অভিযানে অংশগ্রহণকারী আরোহীদের মৃত্যু ঘটেছে।