Alexa Seleno
@alexaseleno

পুরীর  রথযাত্রার অজানা ইতিহাস

ভূমিকা-

          ভারতবর্ষ হল উৎসবের দেশ, এর মধ্যে অন্যতম উৎসব হলো রথযাত্রার উৎসব। হিন্দু ধর্মের অন্যান্য উৎসবের মতোই রথযাত্রাও এক জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া উৎসবটি আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডে এই উৎসব ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালিত হয়। এছাড়া ইসকনের প্রচারের জন্য এখন ডাবলিন মস্কো এবং নিউ ইয়র্ককের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী রথযাত্রা উৎসবটি বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।। কিন্তু রথযাত্রা মানেই প্রথমেই বলতে হয় পৃথিবী বিখ্যাত ওড়িশার পুরীর রথযাত্রার কথা।

            ভাব ও ভক্তিতে ভরা জগতের প্রভু শ্রীজগন্নাথ প্রত্যেক বছর শ্রীমন্দির থেকে বেরিয়ে গুন্ডিচা মন্দিরে যান, শুরু হয়ে যায় রথযাত্রার উৎসব। ন দিন পরে যখন প্রভু শ্রীজগন্নাথ আবার রত্ন খচিত সিংহাসনে ফেরত আসেন তখন রথযাত্রার উৎসবের শেষ হয়। কবে এবং কিভাবে শুরু হয় এই রথযাত্রার উৎসব? 

    কিভাবে শুরু হয় পুরীর এই রথযাত্রার উৎসব? –

              পুরী শ্রীমন্দিরে  প্রভু শ্রীজগন্নাথ কে ঘিরে যতগুলো  উৎসব হয়, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ উৎসব হল রথযাত্রার উৎসব। সারা বছর ধরে শ্রীজগন্নাথ, শ্রীবলরাম এবং দেবী সুভদ্রা, মন্দিরে পূজিত হয়ে থাকেন। শ্রীমন্দিরের প্রশাসনের নিয়ম অনুসারে, হিন্দু ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের ভক্তের শ্রীমন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই। সুতরাং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভক্তদের দর্শন দেবার জন্য ভাই বলরাম এবং বোন দেবী সুভদ্রা কে নিয়ে প্রভু শ্রীজগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরের দিকে যাত্রা করেন। বিশ্বাস রয়েছে রথে অধিষ্ঠিত প্রভু শ্রীজগন্নাথ কে দর্শন করলে সকল পাপের মোচনের সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষলাভও হয়। সে কারণেই রথযাত্রার উৎসবে শামিল হওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন লক্ষ লক্ষ ভক্তবৃন্দ। ন’দিনব্যাপী পালন হয় এই রথযাত্রার উৎসব। রথযাত্রার আরো কয়েকটি নাম আছে, যেমন শ্রী গুন্ডিচা যাত্রা,  ঘোসো যাত্রা পতিত পাবন যাত্রা।

     কবে শুরু হয় পুরীর রথযাত্রার উৎসব? 

              এই বিখ্যাত রথযাত্রার উৎসব ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে এ বিষয়ে ইতিহাসে কোনরকম নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা নেই। তবে ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ অনুযায়ী, এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল সত্যযুগে। অন্ধ পুরানেও উৎকল অধ্যায়ে রথযাত্রার বিষয়ে বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। নবম শতাব্দীর কবি মুরারি মিশ্রের লিখিত সংস্কৃত নাটক অনঙ্গ রাঘবে পুরীতে শ্রীজগন্নাথের মনোরঞ্জনের জন্য রথযাত্রার আয়োজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগ আর নবম শতাব্দীর শুরুতে যজাতি কেশরী পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে রথযাত্রা করার কথা রথ চকাদা নামক বইতে উল্লেখ আছে। উড়িষ্যার অন্যতম কবি ভিখারি পট্টনায়েক ১৮৫৯ সালে এই বইটি প্রকাশ করেছিলেন। এই বইতে উল্লেখ করা আছে যে সেই সময় বিগ্রহদের উচ্চতা প্রায় আড়াই হাত এবং রথের উচ্চতা আট হাত ছিল। রথযাত্রা উৎসবের জন্য ছটি রথ তৈরি করা হতো এবং এই রথ গুলো সমান উচ্চতার নির্মাণ করা হতো। শ্রীমন্দির থেকে তিনজন দেবতা তিনটি রথে অধিষ্ঠিত হয়ে মালিনী নদী পর্যন্ত যেতেন, আর নদী তীরে ওই তিনটি রথ রাখা থাকতো তারপর নৌকোয় করে তিনজন দেবতা গঙ্গা নদী পার করতেন। অন্য পারে রাখা অন্য তিনটি রথে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনজন দেবতা গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত যেতেন। মালিনী নদীর অন্য নাম ছিল বড় নদী। শ্রী মন্দির থেকে বড়রাস্তা পর্যন্ত রাস্তাকে বড়দান্ড আর গুন্ডিচা মন্দির থেকে নদী পর্যন্ত রাস্তাকে সরধাবালি বলা হত। একাদশ শতাব্দীতে চোল রাজাদের সময় ৩২ হাতের ছটি রথ নির্মাণ করা হচ্ছিল। এই সময় রথযাত্রার উৎসবে রাজা নিজে রাজকর্মচারী আর ছটি হাতি দিয়ে রথ টানতেন। রাজা রাঘব দেবের শাসনকালে রথ নির্মাণ করার জন্য রথ নির্মাণকারী গোষ্ঠীকে জমি দিয়ে পাকাপাকি বসবাস করার ব্যবস্থা করেছিলেন।                        

                         ১২৭০ সালে  বিশিষ্ট বৈষ্ণব মাধবাচার্য রথযাত্রার উৎসবে পুরী এসেছিলেন।এই ছয়টি রথের ব্যবস্থা তার একেবারেই পছন্দ হয়নি, তিনি এটাকে অধর্ম বলে বিবেচনা করেছিলেন। তার মতে দেবতা একবার রথের অধিষ্ঠিত হলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগে রথ থেকে নামানো ধর্মবিরুদ্ধ। রথযাতে কোন অসুবিধে ছাড়াই গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত পৌঁছতে পারে সে কারণে অনঙ্গ ভীমদেবের পুত্র রাজা ভানুদেব ১২৬৪ সাল থেকে বালি ফেলে মালিনি নদী বুজিয়ে ফেলার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাজা ভানুদেব নদী বুঝিয়ে ফেলার কাজ শেষ হওয়ার আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন। ১২৭৮ সালে রাজা লাঙ্গুলা নরসিংহ দেব ছটির বদলে তিনটি রথ নির্মাণ করে দেবতাদের শ্রী মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। রাজা যজাতি কেশরীর সময়ে প্রভু শ্রীজগন্নাথ দেবের রথের চাকার সংখ্যা ১৬ ছিল, শ্রীবলরাম দেবের রথের চাকার সংখ্যা ছিল ১৪ আর দেবীর সুভদ্রার রথের চাকার সংখ্যা ১২ ছিল এবং আজও তিনটি রথের চাকার সংখ্যা এই একই আছে।   

    পুরীর প্রতিমা তৈরির ইতিহাস-

              জগতের প্রভু শ্রীজগন্নাথ হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই এক রূপ। ইতিহাসেও রথযাত্রার এই কাহিনীর সঙ্গে জড়িত আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম। ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ অনুযায়ী, মালবদেশের কৃষ্ণভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পান ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করে রথযাত্রা করার জন্য। সেই সময় ওড়িশা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। কথিত আছে যে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পান যে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে জগন্নাথের মূর্তি নির্মাণ করতে হবে। আদেশ আনুসারে মূর্তি নির্মাণের জন্য যখন রাজা উপযুক্ত মূর্তি নির্মাণকারি শিল্পীর সন্ধান করছিলেন, ঠিক সেই সময় এক বৃদ্ধ তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য ২১ দিন সময় চেয়ে নেন। আর মূর্তি নির্মাণকারি শিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে যেন কেউ তার সম্মুখে না আসে, তাতে তার নির্মাণকারজ বাধাপ্রাপ্ত হবে।   

               আর জগন্নাথ হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই এক রূপ। তখন ওড়িশা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। সেখানকার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করেন এবং রথযাত্রারও স্বপ্নাদেশ পান। লোকমুখে শোনা যায়, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পান যে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে জগন্নাথের মূর্তি নির্মাণ করতে হবে। আদেশ অনুযায়ী মূর্তি নির্মাণের জন্য যখন রাজা উপযুক্ত শিল্পীর সন্ধান করছিলেন, ঠিক তখনই এক বৃদ্ধ তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন। তিনি জানান তিনিই এই মূর্তিটি তৈরী করতে পারবেন এবং রাজার কাছে মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন, পাশাপাশি ওই বৃদ্ধ বলেন এই মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেয়। সবার অলক্ষ্যে দরজার আড়ালে শুরু হয় কাষ্ঠমূর্তি নির্মাণ। রাজা, রানী, রাজকর্মচারী সহ সকলেই এই মূর্তি নির্মাণ কাজের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। রানি প্রতিদিন বন্ধ দরজার বাইরে থেকে কান পেতে মূর্তি নির্মানের আওয়াজ শুনতেন। কিন্তু কয়েকদিন পর হঠাৎই একদিন রানী খেয়াল করেন সেই আওয়াজ  বন্ধ হয়ে গেছে। রানী কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে রাজাকে জানাতেই রাজা  ইন্দ্রদ্যুম্ন বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন, দেখেন মূর্তি অর্ধসমাপ্ত এবং শিল্পী উধাও। বিশ্বাস করা হয় যে এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন বিশ্বকর্মা।

          সম্পূর্ণ মূর্তি  নির্মিত হয়নি বলে রাজা ভীষণই দুঃখিত ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। রানীর প্ররোচনায় মূর্তি নির্মাণের কাজে বাধা  জন্য সৃষ্টি করার জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। সেই সময়  দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন এবং নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ ও এই মূর্তি অসম্পূর্ণ রুপেই পূজো শুরু করতে বলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.