ভূমিকা
আমাদের দেসের ইতিহাসে একসাথে তিনটি ট্রেন এর দুর্ঘটনা এই প্রথমবার বোধহয়। ওড়িশার বালেস্বরে এই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটে ২ জুন সন্ধ্যে ৬.৫৫ তে ।এই বীভৎস দুর্ঘটনা নিয়ে উঠছে একাধিক প্রশ্ন। তাহলে এই রকম বীভৎস দুর্ঘটনা ঘটল কিভাবে । যান্ত্রিক গোলযোগের কারনে নাকি কোন রেলকর্মীর ভুলের মাসুল এরকম বীভৎস ভাবে রেল যাত্রীদের দিতে হল। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত শেষ হলেই দুর্ঘটনার কারন জানা যাবে বলে রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন।
ভারতীয় রেল সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ-
পুরো পৃথিবীর হিসেবে সবচেয়ে বেশী সরকারী চাকুরে ভারতীয় রেলে আছে। সারা পৃথিবীতে আর কোনো দেশে, আর কোনো সংস্থায় এত সংখক সরকারী কর্মী চাকুরীরত নেই, এই বিশয়ে ভারত প্রথম স্থানে রয়েছে। কয়েক লাখ কর্মী চাকুরীরত আছে ভারতীয় রেলে। ১২৬১৭ টি ট্রেন এই মুহূর্তে সারা দেশে চলছে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারি, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ট্রেনের লাইন পাতা রয়েছে। প্রত্যেকদিন গড়ে প্রায় দু কটি তিরিশ লাখ মানুষ ট্রেনে যাত্রা করেন। পৃথিবীর মানচিত্রে এরকম অনেক দেশ আছে, যাদের পুরো জনসংখ্যার থেকেও এই সংখ্যাটা বেশী। তার একটি বড় কারন হল আমাদের দেশে সবচেয়ে সহজ এবং সস্তায় রেল যাত্রা সম্ভব।
রেল লাইন সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ-
আমরা জানি পুরো দেশে মেন দুটো লাইন আছে, আপ আর ডাউন, একটা আসার জন্য আর অন্যটা যাওয়ার জন্য । কিন্তু প্রত্যেকটা রেল স্টেশনে আপ আর ডাউন ছাড়াও কিছু এক্সট্রা লাইন বানানো থাকে যাকে লুপ লাইন বলে। ছোট স্টেশনে তিনটে অথবা চারটে আর বড় স্টেশনে ৮ টা পর্যন্ত লুপ লাইন থাকে।মেন লাইন আর লুপ লাইনের মধ্যে পার্থক্য হল মেন সবসময় সোজা যায়। আপ আর ডাউন মেন দুটো লাইন শুধুমাত্র যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত হয় আর ট্রেন এর স্টপেজ দেওয়ার জন্য বা মালগাড়িকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য এই লুপ লাইন গুলোকে ব্যবহার করা হয়।
বালেস্বরে দুর্ঘটনার কবলে কোন কোন ট্রেন?
প্রথম ট্রেন – ২ জুন ১২৮৪১ করমণ্ডল এক্সপ্রেস হাওড়ার শালিমার থেকে দুপুর ৩.২০ মিনিটে প্রায় ১২৫৭ জন যাত্রী নিয়ে ছেড়েছিল। তামিলনাড়ুর কোস্টাল এরিয়ার করমণ্ডল পর্যন্ত এর যাত্রা পথ। ১৬৫৯ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ৩ জুন বিকেল ৪.৩৫ এ চেন্নাই পৌঁছনোর কথা ছিল । প্রায় ২৫ ঘণ্টার জার্নি ছিল এই ট্রেনের এবং সঠিক সময়ে চলছিল এই ট্রেনটি।
দ্বিতীয় ট্রেন- ১২৮৬৪ ইয়সবন্তপুর হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস , সকাল ১০.৩৫ শে বেঙ্গালুরু থেকে ছেড়ে ৩ জুন সন্ধ্যে ৭.৫৫ তে হাওড়া তে পৌঁছনোর কথা ছিল, কিন্তু এই ট্রেনটি ৩ ঘণ্টা দেরীতে চলছিল । দুটো ট্রেন মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজারের ও বেশী যাত্রী ছিল। এই ট্রেন টা দেরীতে চলছিল মানে বাকি সব স্টেশনেও দেরীতেই পৌঁছচ্ছিল। যেহেতু পুরো দেশে দুটো মেন লাইন সে কারনে একটি ট্রেন যদি দেরীতে চলে তাহলে বাকি সব ট্রেনের যাত্রাকে কম বেশী প্রভাবিত করে।
তৃতীয় ট্রেন-বালেস্বরের কাছাকাছি স্টেশন বাহানগা বাজার, যার দূরত্ব ভুবনেশ্বর থেকে ১৭০ কিমি. আর হাওড়া ২৫০ কিমি, এই স্টেশনের লুপ লাইনে একটি মাল গাড়ী দাঁড়ানো ছিল যাতে লোহা ছিল। এই মাল গাড়িটিও দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
চতুর্থ ট্রেন- এছাড়াও বাহানগা বাজার স্টেশনে আরও একটি মাল গাড়ী দাঁড়ানো ছিল। সৌভাগ্যবশত এই ট্রেনটির গায়ে দুর্ঘটনার আঁচ এসে পৌঁছয়নি।
বালেস্বরের বীভৎস দুর্ঘটনা ঘটল কিভাবে?
বালেস্বর স্টেশনে করমণ্ডল এক্সপ্রেস আর ইয়সবন্তপুর হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এই দুটো ট্রেনেরই স্টপেজ ছিল । বালেস্বরে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের থামার সময় ছিল ৬.৩২ মিনিটে আর ইয়সবন্তপুর হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের সময় ছিল ৩ টে বেজে ৪৮ মিনিটে কিন্তু তিন ঘণ্টা দেরীতে বালেস্বরে এসে পৌছয়। সন্ধ্যে ৬ টা বেজে ৫৫ মিনিটের কাছাকাছি করমণ্ডল এক্সপ্রেস বাহানগা বাজার স্টেশনে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে ১২৮ কিমি বেগে মেন লাইন থেকে হঠাৎ করে লুপ লাইন এ ঢুকে পড়ে, লুপ লাইনে দাড়িয়ে থাকা মালগাড়িকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারে। এই প্রচণ্ড ধাক্কায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কয়েকটা কামরা লাইনচ্যুত হয়। ঠিক তখনই গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে উল্টোদিক থেকে ১২৬ কিমি গতিবেগে আসা ইয়সবন্তপুর হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারে। ঠিক এইভাবে বীভৎস দুর্ঘটনাটি ঘটে।
বালেস্বরের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারন-
করমণ্ডল এক্সপ্রেস গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই এগিয়েছে, আবার মালগাড়িটিও নির্দেশ অনুসারে লুপ লাইনে দাড়িয়ে ছিল, অন্যদিকে ইয়সবন্তপুর হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসও গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই এসেছে। শুরুর দিকে তদন্তে এটা প্রমান হয়েগেছে যে কোনো ট্রেন চালকের কোনো ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটেনি, সিগন্যাল ও ফেল ছিল না। এখন তদন্তের বিশয় হল যদি সিগন্যাল গ্রীন ছিল তাহলে করমণ্ডল এক্সপ্রেস মেন লাইনের পরিবর্তে লুপ লাইনে ঢুকল কেন? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে দুর্ঘটনার আসল সত্যিটা।
বালেস্বরের ভয়াবহ দুর্ঘটনার তদন্ত-
বালেস্বরের ভয়াবহ দুর্ঘটনার তদন্তের জন্য রেলমন্ত্রী নিজে সিবিআইর সুপারিশ করেছেন। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীও এই বিশয়ে কোনো আপত্তি জানাননি। সিবিআই এর আগেও রেল দুর্ঘটনার তদন্ত করেছে, এমনটা নয় যে এই প্রথমবার সিবিআই কোন রেল দুর্ঘটনার তদন্ত করেছে।এখন দেখার বিশয় এটাই যে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পেছনের আসল সত্যিটা সবার আনতে ঠিক কতটা সময় নেয় সিবিআই।