ভূমিকা:-
মনিপুর, যাকে বলা হয় মনির ভুমি অথবা রত্নের ভূমি, যদিও এখানে মনি বা রত্ন কিছুই পাওয়া যায় না শুধুমাত্র সৌন্দর্যের কারণে মনিপুরকে রত্নের সাথে তুলনা করা হয়। স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং নিজস্বতার জন্য ব্রিটিশ ভারতে মনিপুর কে বলা হত রাজাদের রাজ্য। চারিদিকে সেভেন সিস্টার দিয়ে ঘেরা মনিপুর একটি অত্যন্ত ছোট রাজ্য যার জনসংখ্যা প্রায় ৩২ লাখের মতো। মণিপুরের রাজধানী হল ইম্ফল, সাতটি পাহাড় দিয়ে ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ইম্পল। ১৯৪৯ এ মনিপুর ভারতের সাথে যুক্ত হয়। হঠাৎ করেই সেই অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা মনিপুরে ভয়ংকর দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছে। দেখে নেওয়া যাক ঠিক কি কারণে এই ভয়ংকর দাঙ্গার সৃষ্টি হল।
মণিপুরের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ-
প্রায় ৩৫ প্রকার আদিবাসি মনিপুরে বাস করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু তিন প্রকার জনজাতির আধিক্য এখানে দেখা যায়, মৈতেই, নাগা আর কুকি। মৈতেই জাতির মধ্যে হিন্দু আর মুসলিম আছে। পুরো জন জাতির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই হল এই মৈতেই জনগোষ্ঠী। নাগা আর কুকিরা হল খ্রিস্টান।পুরো জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হওয়ার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই মইতেই জনগোষ্ঠীর ক্ষমতা সব ক্ষেত্রে বেশী, সেটা শহরাঞ্চলে হোক বা সরকারে। মুখ্যমন্ত্রীও বার দুয়েক ছাড়া প্রায় প্রত্যেকবারই মৈতেই জনগোষ্ঠী থেকেই নির্বাচিত হয়েছে। আর একটা ব্যাপার হল মনিপুরের ইম্ফলের শহরাঞ্চলে এই মৈতেই রা বসবাস করে কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে নাগা , কুকি আর বাকি যত আদিবাসি জনগোষ্ঠী আছে তারা বসবাস করে। যদি এলাকা হিসেবে দেখা যা তাহলে প্রায় দশ শতাংশ এলাকা মৈতেই জাতির দখলে যেটা কিন্তু শহরাঞ্চলেই। বাকি নব্বই শতাংশ পাহাড়ি এলাকা নাগা , কুকি আর বাকি যত আদিবাসি জনগোষ্ঠী আছে তাদের দখলে।
মইতেই জনগোষ্ঠীর দাবি এবং অসন্তোষের কারন কিঃ-
শুরু থেকেই এই শহর আর পাহাড়ের দখলদারি নিয়ে বিবাদ এখানে আছে কিন্তু সেটা ছোটখাটো ঝামেলা। এখন যে ভয়ঙ্কর ঝামেলা চলছে মণিপুরে তার শুরু হয়েছিল প্রায় এগারো বছর আগে। ২০১২ সালে মৈতেই জনগোষ্ঠী একটা সিডিউল ট্রাইব ডিমান্ড কমিটি অফ মনিপুর নামে কমিটি বানায়। এই কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মৈতেই জাতি কেও সিডিউল ট্রাইব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। এদের বক্তব্য হল ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে যুক্ত হবার আগে এরাও সিডিউল ট্রাইব ছিল। সেক্ষেত্রে এরা সিডিউল ট্রাইব হওয়ার যে সুযোগ সুবিধে আছে সেগুলি ভোগ করতে পারবে। মনিপুরে অনেক আইনের মধ্যে একটা আইন আছে যে সিডিউল ট্রাইব না হলে পাহাড়ি অঞ্চলে জমি কেনা যাবে না বা ওখানে গিয়ে থাকা যাবে না । আদিবাসী জাতির জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি ও তাদের নিজস্বতা এই সমস্ত কিছু ধরে রাখার জন্য এই ধরনের আইন তৈরি হয়েছিল। সিডিউল ট্রাইব এর অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার জন্য মৈতেই জাতির লোকেরা পাহাড়ে জমি কেনা বা পাহাড়ে গিয়ে থাকতে পারার সুবিধে ভোগ করতে পারেনা। পরে আস্তে আস্তে মৈতেই জাতিরও মনে হয়েছে যে তাদের সিডিউল ট্রাইবের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আর এইভাবেই ২০১২ থেকে এরা এদের দাবির স্বপক্ষে সরব হয়েগেছিল। বিপরীতে নাগা, কুকি আর বাকী জনগোষ্ঠী মনে করে যে মৈতেইরা সিডিউল ট্রাইবের অন্তর্ভুক্ত হলে ওদের সংরক্ষণের অধিকার খর্ব হবে, মৈতেই জাতির জনসংখ্যা এবং ক্ষমতা এমনিতেই বেশী।তার ওপর শহর আর পাহাড়ী অঞ্চলের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে আলাদা। মৈতেই জাতিকে সিডিউল ট্রাইবের অন্তর্ভুক্ত করা হলে আদিবাসী জাতির জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি, তাদের নিজস্বতা বজায় থাকবে না বলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী মনে করছে। শুধুমাত্র আদিবাসীদের জায়গা জমিতে মৈতেইরা দখল বসাবে এমনটা কিন্তু নয়, এছাড়াও সরকারী আরও অনেক সুযোগ সুবিধে এদের জন্য সংরক্ষিত যেমন স্কুলে, কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে, চাকরির ক্ষেত্রে আছে সেগুলো ও ভাগাভাগি হয়ে যাবে। এই কারণে একটা রাজ্যে বসবাসকারী নাগা, কুকি আর বাকি আদিবাসী জনগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে মৈতেই জাতির বিরুদ্ধে লড়ছে। মৈতেইরা গত এগারো বছর ধরে এই ডিমান্ড করলেও কোন সরকারের ক্ষমতা হয়নি এটা মেনে নেওয়ার। আবার মৈতেই জাতির কথা হচ্ছে ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার আগে ওরা আদিবাসী ছিল, এটা ওদের সাংবিধানিক অধিকার, যেটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
২০২৩ মনিপুরের এর ভয়ঙ্কর দাঙ্গার সূত্রপাত কিভাবে?ঃ-
এগারো বছর ধরে এই দাবি মাইতেইরা তো করছিলই, কিন্তু হঠাৎ এমন কি ঘটল যে ভয়ঙ্কর মনিপুর অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। এই ব্যাপারে মনিপুর রাজ্য সরকার কিছু করেনি, তার কারণ, সরকার জানতো মইতেই পক্ষে কিছু করতে গেলে নাগা কুকি এবংবাকি আদিবাসী জনগোষ্ঠী এটা কিছুতেই মেনে নেবে না, কারণ এটাকে তারা তাদের অস্তিত্বের লড়াই বলে মনে করে। এগারো বছর ধরে যখন কোন সরকার কিছু করল না তখন এই ডিমান্ড নিয়ে মইতেইরা আদালতে যায়। মনিপুর হাইকোর্টে এই মামলা চলছিল।
মনিপুর হাইকোর্টের আসল রায় কি ছিলঃ-
৩মে ২০২৩ এই দিনে এই মামলার শুনানি ছিল।ওই দিন মনিপুর হাইকোর্ট একটি রায় দেয়, আর এই রায় নিয়ে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আসল রায়ে যা কিছু বলা হয়েছিল সেটার পুরো অন্য মানে সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছয়, এবং এই বিভ্রান্তির জন্য মনিপুরে এই ভয়ঙ্কর অশান্তির সৃষ্টি হয়।মনিপুর হাইকোর্ট মনিপুর সরকারকে এই নির্দেশ দেয় যে ডিমান্ড কমিটির যে ডিমান্ড সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই ডিমান্ড এর আদৌ কোন ভিত্তি আছে কিনা, সেই ডিমান্ড মেনে নেওয়া উচিত কিনা, যদি মেনে নেয়া হয় তার কি ভালো দিক আছে এবং কি খারাপ দিক আছে, এই সমস্ত বিষয় খতিয়ে দেখে চার সপ্তাহের মধ্যে যেন আদালতের কাছে একটা রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও মতামত চায়, যে মইতেই জাতি গোষ্ঠীকে সিডিউল ট্রাইব এর অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে দিল্লির কি মতামত। কিন্তু এই আসল রায়ের খবরের বিকৃতি ঘটে এইভাবে সামনে আসে যে আদালত মৈতেই জাতিগোষ্ঠী কে সিডিউল ট্রাইব এর অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু আদালত শুধুমাত্র মতামত জানতে চেয়েছে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের কাছে। আদালত এরকম কোন নির্দেশই দেয়নি যে মৈতেই জাতিগোষ্ঠী কে সিডিউল ট্রাইব এর অন্তর্ভুক্ত করা হোক। মনিপুর হিল এরিয়াজ কমিটি দুঃখ প্রকাশ করে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেয় আদালতের সঠিক নির্দেশটি না জেনেই। এই বিজ্ঞপ্তির পরেই নাগা ও কুকির সাথে আর যে বাকি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছিল তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
৩মে মণিপুরে দাঙ্গার শুরু হয় যেভাবে:-
৩ মে যেদিন কোর্টের রায় আসে সেই দিন অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মণিপুর ,ইম্ফল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে একটা র্যালি বার করে । এই র্যালি তে অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার লোক এসে যোগ দেয়। এই পাহাড়ি আদিবাসীদের র্যালির সামনে মইতেই জাতির ও একটা দল এসে পড়ে আর দু পক্ষই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং খুনোখুনি শুরু হয়ে যায়। আর এই ঘটনার রেস নিমেশের মধ্যে সমস্ত মনিপুরে ছড়ায় আর সেখান থেকে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। যে জায়গায় যে জনগোষ্ঠী ক্ষমতাশালী ছিল তারা অন্যের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে। এই দাঙ্গায় প্রচুর মানুষ খুন হয়। আক্রমণের কোন সময় নেই, দিনরাত সকাল দুপুর যখন যে যাকে পারছে আক্রমণ করছে। এই ভয়ংকর খুন যখন দাঙ্গা হাঙ্গামা দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । আক্রমণের থেকে বাঁচার জন্য রাত্রিবেলা ছোট শিশুদেরকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শোয়ানো হচ্ছে, যাতে তারা রাতে ঘুমের মধ্যে কেঁদে না উঠে। ছোট শিশুরা কেঁদে উঠলে আক্রমণকারীরা জানতে পেরে যাবে এখানে কোন পরিবার রয়েছে। এবং তারা আক্রমণ করবে সেই কারণে এই ব্যবস্থা।
দাঙ্গা দমনে কি ব্যবস্থা মণিপুরেঃ-
এরপর সেনা নামানো হয় আর গভারমেন্ট হাউস থেকে আগে সাবধান করে দেওয়া হয়, তারপর একটা অর্ডার জারি করা হয় যে আক্রমণকারীকে দেখলেই যেন সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে দেওয়া হয়। সেনা কে এলার্ট করে দেওয়া হয়েছে, এরপর আস্তে আস্তে মনিপুর শান্ত হতে থাকে। পনেরো হাজারেরও বেশি ফ্যামিলি নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে রিলিফ ক্যাম্পে এসে রয়েছে, সেখানে তারা নিজেকে সেফ বলে মনে করছে। এই দাঙ্গায় পুলিশের তরফ থেকে যে মৃত্যুর সংখ্যা বলা হচ্ছে, সেটা সঠিক নয় বলে স্থানীয় মানুষের দাবি।