Alexa Seleno
@alexaseleno

ইংল্যান্ডের মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর জীবনী আর কিছু  অজানা কাহিনী (১৯২৬-২০২২)

মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (ভূমিকা)

          চিরঘুমে চলে গেলেন  ব্রিটেনের মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, মৃত্যুকালে তাঁর বয়েস হয়েছিল ৯৬ বছর। বিতর্ক, সমালোচনা, ভালোবাসা, অনুশাসন সমস্ত কিছু মিলিয়ে দীর্ঘ সাত দশক ধরে চলা  বিশ্ব ইতিহাসের বর্ণময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। বৃহস্পতিবার, 27 সেপ্টেম্বর ২০২২ শে  স্কটল্যান্ডের বালমোরের ক্যাসেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রানীর মৃত্যুতে ইংল্যান্ড জুড়ে শোকের ছায়া। প্রথা অনুযায়ী ব্রিটেনের রাজা হলেন তাঁর বড় ছেলে চার্লস। 

মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (জন্ম ও শিক্ষা)

                    ২১ এপ্রিল ১৯২৬ শে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম লন্ডনে হয়। ওই  সময় ওনার পিতামহ জর্জ পঞ্চম এর শাসনকাল চলছিল। পিতা অ্যালবার্ট ডিউক অফ ইয়র্কের আর ওনার মা রাণী এলিজাবেথ এর প্রথম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ওনার মায়ের নাম ও এলিজাবেথ ছিল, যিনি ইয়র্কের ডাচেস  ছিলেন।  সে কারণেই রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামে তিনি বিখ্যাত হন। তিনি কোনদিনও স্কুলে যাননি, বাড়িতেই তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ওনার মা এবং আরেকজন শিক্ষিকার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি একাধিক ভাষা জানতেন  এবং ঘোড়া আর পোষা কুকুরের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা ছিল তার। তিনি প্রায়ই অলিম্পিয়া ইন্টারন্যাশনাল হর্স শো দেখতে যেতেন। 

মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (কর্মজীবন ও বিবাহ)

                 রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ বৃটেনের রক্ষার জন্য নিজের মনপ্রাণ শুরু থেকেই সমর্পণ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি গার্ল গাইড হন, গার্ল গাইড হল একটি চ্যারিটেবল সংস্থা। ১৯৪৫ সালে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্য তিনি রেডিও  বার্তা দিয়েছিলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি উইমেন্স অক্সিলারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিস এ যোগ দেন আর ড্রাইভার ও মেকানিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন।

                           রাজকুমারী এলিজাবেথ ২১ এপ্রিল ১৯৪৭ সালে ২১ বছর বয়সে দেশের উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ দেন।  তিনি সাউথ আফ্রিকা সফরে  গিয়েছিলেন, ওই সময় সাউথ আফ্রিকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নিজের  ভাষণে তিনি  বলেছিলেন, আমি আমার পুরো জীবন সমাজের এবং পরিবারের জন্য উৎসর্গ করলাম, আমরা সবাই একটা পরিবারের অংশ, ওই সময় তিনি রানী ছিলেন না, রাজকুমারী ছিলেন। এলিজাবেথ ১৩ বছর বয়সে ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনকে নিজের হৃদয় দিয়ে বসে ছিলেন। ফিলিপ মাউন্টব্যাটেন গ্রিস এর রাজকুমার ছিলেন। ওদের দুজনের মধ্যে যে কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেটা প্রকাশ্যে চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ২০ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে রাজকুমারী এলিজাবেথ আর ফিলিপ মাউন্টব্যাটেন এর বিয়ে হয়ে যায়। এই রাজকীয় দম্পতিকে একবার দেখা পাওয়ার জন্য বাকিংহাম প্যালেসের সামনে মানুষের ভিড়  উপচে পড়েছিল। এই রাজা রানীর বিয়ের পরে  আমাদের দেশ ভারতবর্ষ নিজের স্বাধীনতা পাওয়ার উৎসব উৎযাপনের প্রস্তুতিতে নেমেছিল। এই দম্পতির প্রথম সন্তান প্রিন্স চার্লস ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এরপরে ১৯৫০ সালে বাকিংহাম প্যালেসে রাজকুমারী অ্যানির জন্ম হয়।  

           বিয়ের প্রায় ৫ পরে রাজকুমারী এলিজাবেথ আর ফিলিপ মাউন্টব্যাটেন কেনিয়া সফরে ছিলেন, সেই সময় তিনি তার পিতা রাজা জর্জের মৃত্যুর খবর পান। তার পিতা রাজা জর্জ দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। ব্রিটেনে পৌঁছনোর পরেই খুব তাড়াতাড়ি রাজকুমারী এলিজাবেথকে মাহারানি ঘোষণা করা হয়েছিলো। ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে তাঁর মাথায় ব্রিটেনের সিংহাসনের মুকুট ওঠে। ২ জুন ১৯৫৩ সালে ওনার আধিকারিক রুপে রাজ্যাভিষেক করা হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সাত দশক ধরে তিনি এই দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করছিলেন। মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বয়েস কেবলমাত্র ২৫ ছিল যখন ওনাকে ব্রিটেনের সিংহাসন সামলানোর মতো গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানের প্রসার সমস্ত পৃথিবীতে দূরদর্শনের মাধ্যমে করা হয়েছিল।রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের দিন প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে প্রায় তিরিশ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান দূরদর্শনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে গেছিল। এরকম কোণো অনুষ্ঠান প্রথমবার দূরদর্শনের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীর সামনে সম্প্রচার করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ বলেন, এই গুরুদায়িত্ব সামলানোর জন্য আমার কাছে খুবই অল্প অভিজ্ঞতা আছে। 

             মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সাথে সাথেই ব্রিটেনে একটি স্বতন্ত্র শাসনের শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিন দশক ধরে থাকা একটি সুপার পাওয়ার ব্রিটেন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছিল। এই সময় তিনি কমনওয়েলথ এর মাধ্যমে ব্রিটেনের সুপার পাওয়ার ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা করেন। নিজের শাসনকালে বড় বড় বিপদেও তিনি ঘাবড়াতেন না। প্রধানমন্ত্রী  মার্গারেট থ্যাচারের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মহারানীর মতবিরোধ হয়। তারপরেও তিনি রাজ্যভার দক্ষতার সাথে সামলে নেন। 

               ১৯৬১ সালে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঘানা সফর করেন, সেই সময় ঘানা অনেকরকম সমস্যার সাথে লড়ছিল। একজন ক্ষমতাশালী রাজার কুদৃষ্টি ও পরেছিল ঘানার ওপর, কিন্তু এত বাধা থাকা সত্ত্বেও তিনি এই সফর করেন এবং বুদ্ধি ও ক্ষমতার বলে সমস্ত সমস্যার সামাধান করেন। আর এই সফর পুরো দুনিয়ার সামনে একজন যুবা মহারানীর বুদ্ধি ও ক্ষমতার প্রকাশ করে দেয়।   

মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (ভারত সফর)                 

      মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার জীবনকালে তিনবার ভারত সফর করেন। ১৯৬১, ১৯৮৩ আর ১৯৯৭ সালে তিনি মোট তিনবার ভারতের রাজকীয় অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। ১৯৬১ সালে ভারতের গণতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অতিথি ছিলেন মহারানী। ১৯৮৩ তে ব্রিটিশ মহারানী কমনওয়েলথ দেশগুলোর বৈঠকে অংশ নিতে ভারত সফরে আসেন। এই সফরে এসে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখাও করেন। এরপরে ১৯৯৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির বিশেষ উপলক্ষে তিনি শেষবারের মতো ভারতে আসেন। এই সফরে মহারানীকে রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অফ অনার সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছিল। কিন্তু বার বার আবেদন জানানোর পরেও কোহিনূর হিরে ফেরত না দেওয়ার জন্য মহারানী ভারতে ভীষণভাবে সমালোচিতও হয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে মহারানী চীনে সফর করেছিলেন, এটা প্রথমবার কোন সফর ছিল যেখানে ব্রিটেনের কোনো শাসক চিনে সফর করছিলেন। ওনার পূর্বে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী  মার্গারেট থ্যাচার চিনে সফর করেছিলেন। মহারানীর এই চীন সফরকে রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়।

           ৩১ শে আগস্ট ১৯৯৭ সালে রাজবধূ লেডি ডায়নার মৃত্যুর পরে রাজ পরিবার তীব্র সমালোচনার শিকার হয়।   লেডি ডায়নার তাঁর সময়ে একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব  ছিলেন। প্রিন্স চার্লসের সাথে তাঁর প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ এবং তাঁর মৃত্যু সমস্তটাই ভীষণভাবে প্রচারে ছিল। লেডি ডায়নার দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়ে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতিক্রিয়া অনেকটা সময় পরে সামনে আসে, এই বিষয়েও সমালোচনা কিছু কম হয়নি। 

                  মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসন এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে চলা দ্বিতীয় শাসনকাল। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে মহারানীর শাসনকালের  ৬০ বছর পূর্ণ উপলক্ষে তিনি ডায়মন্ড জুবিলি পালন করেন। 2015 সালে, মহারানী তার প্রমাতামহ ভিক্টোরিয়ার দীর্ঘ রাজত্বের রেকর্ড ভেঙে দেন। ৯ সেপ্টেম্বর  ২০১৫ সালে  তিনি প্রথম মহিলা শাসক হন, যিনি সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে শাসন করছিলেন। জুন মাসে রানীর ব্রিটিশ সিংহাসনে বসার ৭০তম বার্ষিকী উৎযাপন করেছিল ইংল্যান্ড। অসুস্থতার কারণে প্লাটিনাম জুবিলির অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে খুব একটা আসেনি তিনি, চিকিৎসকেরা তাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।     

মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের (অসুস্থতা ও মৃত্যু)

      ৯ এপ্রিল ২০২১ সালে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের ৯৯  বছর বয়সে মৃত্যু ঘটে। মহারানী ও  প্রিন্স ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনের  বিয়ের ৭৩ বছর পূর্ণ হয়ে গেছিল। করোনা ভাইরাসের কারণে হওয়া লকডাউনে প্রিন্স ফিলিপ মহারানীর সাথেই  উইনডশোর ক্যাসেলেই ছিলেন। এপ্রিল ২০২০ তে করোনা ভাইরাস এ  লড়তে থাকা দেশকে বাঁচানোর জন্য অনেক রকম ভাবে প্রচেষ্টা করেন তিনি।                

ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিস ট্রাস যখন মহারানীর সাথে দেখা করতে বালমোরাল ক্যাসেলে গিয়েছিলেন ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ এ,  সেই দিনে ওনার অন্তিম ছবি তোলা হয়। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর মহারাণীর হঠাৎই ভীষণ শরীর খারাপ হয়, এবং ওনার মৃত্যু ঘটে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.