সাইরাস মিস্ত্রি ( ভূমিকা)
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রির(০৪/০৯/২০২২), মৃত্যুকালে 54 বছর বয়স হয়েছিল তার। আমেদাবাদ থেকে মুম্বাই ফেরার পথে মুম্বাই আমেদাবাদ হাইওয়েতে পালঘরের কাছে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। গাড়িতে মোট চারজন ছিলেন, দুর্ঘটনাস্থলে সাইরাস মিস্ত্রি সহ আরেকজনের মৃত্যু ঘটেছে। আর দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 2012 থেকে 2016 সাল পর্যন্ত টাটা ষ্ঠীর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। মাত্র 44 বছর বয়সে তিনি টাটা গোষ্ঠীর ষষ্ঠ চেয়ারম্যান পদে আসীন হয়েছিলেন এবং তিনি ছিলেন দ্বিতীয় চেয়ারম্যান যার পদবী টাটা ছিল না।
কে ছিলেন সাইরাস মিস্ত্রি?
সাইরাস মিস্ত্রির জন্ম হয় তিনি ওনার পরিবার আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বিত্তবান ভারতীয় পরিবার ছিল এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে ওনার পরিবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাতে রয়েছে।ওনার পিতা পালনজি শাপূর্জি মিস্ত্রির খুব একটা চর্চা হতো না, তিনি জনসংযোগে খুব একটা থাকতেন না কিন্তু শুধুমাত্র ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন ছিলেন। সাইরাস মিস্ত্রি পালনজি শাপূর্জি মিস্ত্রির সবচেয়ে ছোট ছেলে ছিলেন। আয়ারল্যান্ডে।লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এটা প্রায়ই ঠিকই ছিল যে তিনি তাঁর পরিবারের ব্যবসা সামলাবেন। ১৯৯১ সালে সাইরাস মিস্ত্রি শাপূর্জি পালনজি এন্ড সন্স কোম্পানিতে কাজ করা শুরু করেন।১৯৯৪ সালে সাইরাস মিস্ত্রিকে ডিরেক্টর পদটি দেওয়া হয়েছিল। উনার নেতৃত্বে শাপূর্জি পালনজি এন্ড সন্স কোম্পানি প্রচুর মুনাফা লাভ করে, কোম্পানির টার্নওভার দুই কোটি পাউন্ড থেকে প্রায় দের বিলিয়ন পাউন্ড হয়ে গেছিল। কোম্পানি মেরিন, তেল,গ্যাস আর রেলওয়ে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা শুরু করে। এইসময় কম্পানি কনস্ট্রাকশনের কাজ দশটারও বেশী দেশে শুরু হয়। সাইরাস মিস্ত্রির নেতৃত্বে শাপূর্জি পালনজি এন্ড সন্স কোম্পানি ভারতে বেশকিছু রেকর্ডের সৃষ্টি করে, এদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার নির্মাণ, সবচেয়ে বড় রেলওয়ে পুল নির্মাণ এবং সবচেয়ে বড় বন্দর তৈরি করা কৃতিত্ব অর্জন করে। আর তার ব্যবসা ভারত, পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। সাইরাস মিস্ত্রি এক হাজার কোটিরও বেশি সম্পত্তি রেখে গেছেন। সাল ২০০৬এ তিনি টাটা গোষ্ঠীর বোর্ডে যুক্ত হন, সাল ২০১২ তে রতন টাটার অবসর গ্রহণের পরে তিনি টাকা গ্রুপে ষষ্ঠ চেয়ারম্যান পদে বসেন।সাল ২০১৬ তে টাটা গোষ্ঠীর বোর্ড ভোট করে সাইরাস মিস্ত্রি কে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়।
সাইরাস মিস্ত্রির সাথে টাটা গোষ্ঠীর বিবাদের কারণ
টাটা গোষ্ঠীর কর্ণাধার রতন টাটার সঙ্গে সাইরাস মিস্ত্রির খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ওনাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে খুবই চর্চা হত, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি চর্চা হয় ওনাদের সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া দূরত্ব নিয়ে। ২০১২ সালে রতন টাটাকে সরিয়ে সাইরাস মিস্ত্রি কে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল, আবার ২০১৬ সালে উনাকে হঠাৎই টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সাইরাস মিস্ত্রি আমাদের দেশের একটি কোটিপতি পরিবারের সন্তান। মিস্ত্রি পরিবারের কাছে টাটা গোষ্ঠীর ১৮.৪ পার্সেন্ট শেয়ার ছিল এবং বলা হয় টাটা গোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি শেয়ার এই শাপূর্জি পালনজি এন্ড সন্স কোম্পানির কাছে আছে। আমাদের দেশে কর্পোরেট জগতের যত বিবাদ হয়েছে তারমধ্যে সাইরাস মিস্ত্রী এবং রতন টাটার বিবাদ টাকে সবচেয়ে বড় করে দেখা হয়। বছরের পর বছর এদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অশান্তি চলতে থাকে, অনেক মধ্যস্থতা, অনেক চেষ্টার পরেও এদের মধ্যে কোন সমাধান করা যায়নি।মিডিয়া রিপোর্টার হিসেবে, ভোটের জন্য টাটা গ্রুপ চাঁদা কিভাবে দেবে, কোন কোন প্রজেক্টে কিভাবে টাকা বিনিয়োগ করা হবে, টাটা গ্রুপ আমেরিকার ফাস্ট ফুড চেইনের সাথে জুড়বে কিনা, এসব নিয়েই মতভেদের সৃষ্টি হয় এবং দিনে দিনে তা অশান্তিতে পরিণত হয়। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় দিনে দিনে অশান্তি এই পর্যায়ে পৌঁছেছে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছতে হয় দুই পক্ষকে। টাটা গোষ্ঠী মিস্ত্রিদের মালিকানায় থাকা এসপি গ্রুপের শেয়ার কিনে সেটাকে টাটা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত করা প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু মিস্ত্রি পরিবার এই প্রস্তাব স্বীকার করেনি। যে কারণে দুই পক্ষ কোর্টে পৌঁছয় এবং সেখানে মামলার রায় রতন টাটার পক্ষে আসে। মিস্ত্রি পরিবারের এসবি গ্রুপের অনেক দেনা হয়ে গেছে। মিস্ত্রি পরিবার টাটা সন্স এর কিছু শেয়ার কেও বন্ধকে রাখে যে কারণে ও অশান্তি হয়। এছাড়াও ভোটের চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে আর একটা অশান্তি ছিল বলে মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায়। বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো রাজনৈতিক চাঁদা দেয়, আমাদের দেশে এই অলিখিত নিয়ম টা শুরু থেকেই আছে। টাটা সন্স কেও রাজনৈতিক চাঁদা দিতে হয়, এরকমই ওড়িশাতে একটা চাঁদা দেওয়ার বিষয় নিয়ে টাটা আর মিস্ত্রির মধ্যে ভীষন অশান্তি শুরু হয়, এরকম কিছু মিডিয়া রিপোর্ট সামনে আসে। ২০১৪ সালে ওড়িশাতে বিধানসভা ভোটের সময় এই চাঁদার বিষয়ে অশান্তি শুরু হয় আর এইসব অশান্তির ব্যাপারে খবর কখনো খোলাখুলি ভাবে সামনে আসেনি। বলা হয় সাইরাস মিস্ত্রি কাজের ধরন, টাটাদের কাজের ধরনের থেকে একেবারেই আলাদা। এছাড়াও আরো কিছু বড় কর্পোরেট ডিল ছিল যেগুলো টাটাগোষ্ঠীর বোর্ডকে না জানিয়ে সাইরাস মিস্ত্রি করেছেন এবং কর্পোরেট আইনের অমান্য করেছেন বলে টাটা গোষ্ঠীর দাবি।
সাইরাস মিস্ত্রির গাড়ি দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণ
প্রাথমিকভাবে সাইরাস মিস্ত্রির গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ার কয়েকটি কারণ
সামনে এসেছে, যেমন খারাপ রাস্তা, হাই স্পিড, আর সিট বেল্ট না বাঁধা, ভারতে বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই হাই স্পিড এর কারণে হয়। ভীষণ খারাপ রাস্তায় হাই স্পিডে চলা গাড়িতে সিটবেল্ট না বেধে বসে থাকার মাশুল প্রাণ দিয়ে দিতে হয়. এরপরেও মানুষ গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট না বাঁধার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কাজটা করে। এছাড়াও আমরা দেখতে পাই খারাপ রাস্তাও অনেক দুর্ঘটনার কারণ হয়। মুম্বাই আমেদাবাদ হাইওয়েতে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে, আশা করা হয় হাইওয়ে রাস্তার ম্যানেজমেন্ট সবসময় ভালো হবে তার কারণ হাইওয়েতে মোটামুটি গাড়ির স্পিড অনেক বেশি থাকে কিন্তু যেখানে দুর্ঘটনাটি ঘটে সেই জায়গার রাস্তা ভীষণ খারাপ ছিল তাছাড়াও ওই জায়গায় রাস্তাটা হঠাৎ করেই থ্রি লেন থেকে টু লেন হয়ে গেছে । চওড়া রাস্তা হঠাৎ করে সরু হয়ে যাওয়ার জন্য ড্রাইভাররা অনেক সময় স্পিড কন্ট্রোল করতে পারে না যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।যদিও রাস্তায় এই একটি লেন কমে যাওয়া সম্পর্কে পূর্বে কোনো তথ্য নেই, যেমনটা হাইওয়েতে বিভিন্ন বোর্ডের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এই হঠাৎ করে চওড়া রাস্তা শুরু হয়ে যাওয়াটা কে এই দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ গাড়ি মার্সিডিজ জি এল সি 220, সিটবেল্ট বাঁধা থাকলে এই গাড়িতে নিরাপত্তার কয়েকটি ফিচার কাজ করা শুরু করে। কিন্তু সাইরাস মিস্ত্রি সিটবেল্ট না বেঁধে বসে থাকার জন্য এআর ব্যাগ খোলেনি এবং দুর্ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারান ।এয়ার ব্যাগ এর কাজ হল বেশি চোট-আঘাত থেকে বাঁচানো। একটু অসাবধানতার জন্য 54 বছর বয়সে সাইরাস মিস্ত্রি না ফিরে আসার দেশে চলে যান।