আমাদের দেশে এই মুহূর্তে সমস্ত মিডিয়া হাউজ ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম গুলো একটি নামের ঢেউয়ে ভেসে চলেছে সেই নামটি হলো বিলকিস বানু। এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত ভাবে জানব কি হয়েছিল বিলকিস বানুর সাথে, তার অপূরণীয় ক্ষতির জন্য গুজরাট সরকার কি ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। আর কোন আইনে 2022 সালে তার দোষীরা জেল থেকে ছাড়া পেল।
২৭ ফেব্রুয়ারি,২০০২, কী হয়েছিল বিলকিস বানুর সাথে?
গুজরাতের দাহদ জেলার রন্ধকপুর গ্রামে বিলকিস বানু পরিবারের সাথে বসবাস করতেন ।তিন বছর বয়সের একটি কন্যা সন্তান তার ছিল। সেই সময় সে ৫ মাসের গর্ভবতী ছিল। ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাতের গোধরা স্টেশনে সবরমতী এক্সপ্রেসের কোচ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ট্রেনে করে অযোধ্যা থেকে ফিরছিলেন কারসেবকরা। এই ঘটনাতে কোচে বসা ৫৯ জন করসেবকের আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়। এর পর গুজরাতে দাঙ্গা শুরু হয়।এই দাঙ্গা তে প্রায় ১০০০ এর ও বেশি মানুষ প্রান হারায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাতের গোধরা স্টেশনে সবরমতী এক্সপ্রেসের কোচ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার ঠিক ৪ দিন পরে বিলকিস বানুর ঘটনা ঘটেছিল। সবরমতী এক্সপ্রেসের কোচ পুড়িয়ে দেওয়ার পরে গুজরাতের আলাদা আলাদা জায়গায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছিল। দাঙ্গাবাজরা দাহদ জেলার রন্ধকপুর গ্রামে ও এসে পৌঁছেছিল। এখানেও দাঙ্গাবাজরা হত্যালীলা চালায়, মানুষের ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তার মধ্যে একটি ঘর ছিল বিলকিস বানুদের ছিল। বিলকিস বানু নিজের পরিবারের ১৭ জনের সাথে কোনোরকম প্রাণ বাঁচিয়ে ওখান থেকে পালায় এবং ওরা গ্রাম থেকে কিছু দূরে একটি খেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।দাঙ্গাবাজরা কোন ভাবে জানতে পেরে যায় ওই খেতে কিছু মানুষ লুকিয়ে আছে।প্রায় ৩০ জনের একটি দাঙ্গাবাজের দল ওই খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।১৭ জনের মধ্যে ১০ জন ওখান থেকে পালাতে পারে কিন্তু বিলকিস তার মা, তার ৩ বছরের কন্যা সন্তানসহ ৭ জন ওখাণে ফেঁসে যায়।
এরপর দাঙ্গাবাজরা প্রথমে ৪ জন মহিলা তারপর পুরুষদের হত্যা করে। বিলকিসের মা সহ মহিলাদের কে ধর্ষণ করা হয় এবং মেরে ফেলা হয়, তার ৩ বছরের কন্যা সন্তানের ও রেহাই ছিল না, সেই ছোট্ট মাথাটা থেঁতলে দেওয়া হয়। বিলকিসকে দফায় দফায় ধর্ষণ করার পর মৃত ভেবে ওই ক্ষেতে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়। গণধর্ষণ হয়েছিল বিলকিস এর সাথে ।
বিলকিস বানুর সংঘর্ষ
৩ ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরলে সে নগ্ন অবস্থায় কোনভাবে খেতের বাইরে আসে। এক মহিলার থেকে কাপড় নিয়ে নিজেকে কোনভাবে সামলে নিয়ে এক হোম গার্ড এর সাথে পাশে থাকা লীমখেড়া পুলিশ স্টেশন পৌঁছয়। সোমা ভাঈ গরি নামের এক কনস্টেবল ডিউটি টে ছিলেন। তিনি পুরো ঘটনা শোনার পর প্রথমে হসপিটালে আর তারপর দাঙ্গা পীড়িত দের রিলিফ ক্যাম্পে বিলকিসকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোন অভিযোগ না নিয়ে। এই অবস্থাই বিলকিস লীমখেড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করার জন্য বলছে কিন্তু অভিযোগে নেওয়া হচ্ছে না।উল্টে বিলকিস কে ভয় দেখানো হতে থাকে যে সে যদি অভিযোগ দায়ের করে তাহলে তাকে আইনিভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে, কারণ তার সাথে যা ঘটেছে তার কোন প্রমাণ নেই। এই অবস্থায় বিলকিস ক্রমাগত অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা করে যেতে থাকে।এই সময় বিলকিসের কাহিনী মিডিয়াতে আসে, কিছু এনজিও ও কিছু মহিলাদের সংগঠন বিলকিসের কাহিনী দুনিয়ার সামনে নিয়ে আসে। এরপর ওপর মহল থেকে বিলকিসের ঘটনার ওপর কাজ করার জন্য পুলিশের ওপর চাপ আসতে থাকে। পুলিশের একটাই বক্তব্য ছিল যে তাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই।তখন বিলকিস ন্যায় বিচারের জন্য সুপ্রিমকোর্টে দরজায় পৌঁছয়।সুপ্রিম কোর্ট বিলকিসের পুরো কাহিনী শোনার পর রায় দেয় যে, এই ঘটনার তদন্ত সিবিআই করবে।ওই সময় গুজরাটের এরকম অনেক ঘটনার তদন্ত সিবিআই করছিল।
বিলকিস বানুর কেস এবং কোর্টের রায়
বিলকিসের ঘটনার তদন্ত করে সিবিআই জানতে পারে, শুরু থেকেই বিলকিসের সাথে অবিচার হয়েছে, পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেনি, ডাক্তাররা ভুল মেডিকেল রিপোর্ট বানিয়েছে। এসব দেখে তদন্তের স্বার্থে অনুমতি নিয়ে সিবিআই কবর থেকে লাশ করে বার করে। সেখানে দেখা যায় প্রত্যেকটা লাশের ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। তদন্তে এটাও উঠে আসে, যারা হত্যালীলা চালায় তারা প্রত্যেকে বিলকিসের গ্রামের বাসিন্দা ছিল। শনাক্তকরণের সময় তাদের প্রত্যেকের নাম ধরে শনাক্ত করতে পারে বিলকিস। সমস্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিবিআই ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। এরপর বিলকিসের ওপর প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকে এই কেস তুলে নেওয়ার জন্য, নাহলে ওর পরিবারের বাকি যে কজন আছে তাদেরকেও শেষ করে দেওয়া হবে। এসবের জন্য বিলকিস আবেদন জানায় যে গুজরাটের মধ্যে কোন কোর্টে এই কেস ন্যায়বিচার পাবে না, সে কারণেই এই কেস যেন গুজরাটের বাইরে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট ওর আবেদন মঞ্জুর করে দেয়, আর এই কেস টাকে গুজরাটের বাইরে মুম্বাই ট্রানস্ফার করে দেয়। মুম্বাইতে সিবিআই এর কোর্টে এই কেসের শুনানি হয়।এর মধ্যে শুনানি চলাকালে দু’জন অভিযুক্তের মৃত্যু ঘটে। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে সিবিআই এর বিশেষ কোর্ট ১৬ জনের মধ্যে ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ৫ জন পুলিশ কর্মী এবং একজন ডাক্তার সহ ১১ জনকে এই সাজা দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন মুম্বাইয়ের হাইকোর্টে যায়। সিবিআই ও মুম্বাই হাইকোর্টে যায় কারণ তাদের ইচ্ছে ছিল ১১ জনের যেন ফাঁসির সাজা হয়। মুম্বাই হাইকোর্টে শুনানির পর রায়ের কোন পরিবর্তন হয়না। এই রায়ের বিরুদ্ধে ও সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন সুপ্রিমকোর্টে যায়। সুপ্রিমকোর্টে ও এই রায়ের কোন পরিবর্তন হয়না। পরে সুপ্রিম কোর্ট এদের রিভিউ পিটিশন ও বাতিল করে দেয়। তারপর সাজাপ্রাপ্তদের গুজরাটের গোধরা জেলে রাখা হয়। এই সমস্ত কিছুর পরে বিলকিস ক্ষতিপূরণের জন্য সুপ্রিমকোর্টে আবেদন জানায় যে তার পুরো জীবন আর পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে ক্ষতিপূরণের জন্য ৫০ লাখ টাকা, সাথে একটা বাসযোগ্য বাড়ি আর চাকরি দেওয়ার জন্য আদেশ দেয়। এর আগে আমাদের দেশে কোনো কেসে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়া হয়নি। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই ১১ জন দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি বহাল রাখে। বিলকিস বানুর ওপরে যে চরম অন্যায় অত্যাচার হয়ে গিয়েছিল তার বিচার পেতে দীর্ঘ ১৫ বছর সময় লেগে যায় আর এইভাবে বিলকিস বানুর মামলার নিষ্পত্তি ঘটেছিল।
বিলকিস বানুর দোষীরা শাস্তি হওয়ার পরেও জেলের বাইরে কেন
আমাদের দেশে remission policy নামে একটি আইন আছে, যে আইনের জন্য বিলকিস বানুর দোষীরা সাজা প্রাপ্ত হয়েও আজ জেলের বাইরে রয়েছে। একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যে অনেকদিন ধরে জেলে রয়েছে সে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর মানে অনেকবছর হয়ে গেছে, এরকম সময় পরে মুক্তির জন্য আবেদন করতে পারে। তার বয়স, স্বাস্থ্য, জেলে থাকার সময়কাল এবং যে সংশোধনের জন্য জেলে থাকা সেই সংশোধন কতটা হয়েছে, এই সব খুঁটিনাটি বিশয়ে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই ব্যক্তি কে মুক্তি দেওয়া হবে কিনা। Remission policy এর মাধ্যমে যখন কাউকে ছাড়া হয় তার জন্য একটা বিশেষ উপলক্ষ বা দিন ধার্য করা হয়।কিন্তু ২০১৪ সালের পরে যে remission policy এসেছে তাতে এইভাবে ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো বিধান দেওয়া হয়নি। তাহলে বিলকিস বানুর দোষীরা কিভাবে ছাড়া পেল। এই দোষীদের ক্ষেত্রে একটা যুক্তি খাড়া করা হয়েছে। যেহেতু এদের প্রথম দণ্ডাদেশ এসেছিল ২০০৮ সালে, সে কারণে ১৯৯২ সালের remission policy হিসেবে এরা ছাড়া পেয়েছে। এদের ২০১৪ সালের নতুন কঠোর remission policy প্রযোজ্য না করে পুরনোটাই প্রযোজ্য করা হলো।