বাংলা সিনেমা জগতের কিংবদন্তী পরিচালক তরুণ মজুমদার প্রয়াত হলেন । মৃত্যুকালে কিংবদন্তী পরিচালকের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ১৪ জুন থেকে তিনি ভর্তি ছিলেন এসএসকেএম হসপিটালে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল বর্ষীয়ান পরিচালক তরুণ মজুমদারেরর। রবিবার থেকেই হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি শুরু হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় বর্ষীয়ান পরিচালককে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। সোমবার অর্থাৎ ৪ জুলাই ২০২২-এ সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুর আগে তিনি কিডনি ও হৃদরোগেও ভুগছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া চলচ্চিত্র জগতে। গভীর শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। শোকপ্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্র জগতে একাধিক তারকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী। শোকপ্রকাশ করেছেন প্রসেনজিৎ, রঞ্জিত মল্লিক. শতাব্দী রায়। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন দেবশ্রী রায়। গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই ভারত একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালককে চিরতরে হারিয়েছে।
তরুণ মজুমদারের প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
তরুণ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি অবিভাক্ত বাংলার বগুড়ায় গ্রামে। যে জায়গাটা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত। তাঁর পিতা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে এবং উত্তরবঙ্গের ভুটান বর্ডার এর পাশাপাশি একটা জায়গায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন করেন। রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র পরিচালনাই পেশা হিসেবে বেছে নেন স্কটিশচার্চ কলেজের এই প্রাক্তনী।
তরুণ মজুমদারের পারিবারিক জীবন
তরুণ মজুমদারের প্রায় কুড়ি টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন বাংলার বিখ্যাত অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়। ঠিক কবে তারা একে অপরের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান সেটা জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়, একসাথে কাজ করার সময় দুজনের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তারা ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন একসাথে সফলভাবে সংসার করার পর তারা আলাদা হন। যদিও তাদের মধ্যে কোন আইনি বিচ্ছেদ হয়নি। অভিমান থাকলেও পরস্পর পরস্পরের খোঁজখবর সবসময় রাখতেন ।আজও স্বামীর নাম হিসেবে সন্ধ্যা রায় তরুণ মজুমদারের নাম উল্লেখ করেন ।
কিন্তু এই বিচ্ছেদের পেছনে কী কারণ ছিল? শোনা যায় তরুণ মজুমদার পরিচালিত সিনেমা সজনী গো সজনী নায়িকা মহাশ্বেতা রায় এর সাথে সম্পর্কের কারণে এই সফল দাম্পত্যে ফাটল ধরে। যদিও এই বিষয়ে তাঁরা দুজন সংবাদমাধ্যমের সামনে কখনোও কোনো কথা বলেননি।
তরুণ মজুমদার কর্মজীবন
তরুণ মজুমদার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক যা বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজের চিত্রায়নের জন্য পরিচিত। তার সিনেমাতে গ্রাম বাংলার সহজ-সরল দৃশ্য জীবন্ত হয়ে দর্শকের চোখে ফুটে উঠত। তিনি অনেক বড় বড় লেখকদের লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের উপর ভিত্তি করে সিনেমা নির্মাণ করতেন। তিনি তার সিনেমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ও সুর করা গানও ব্যবহার পছন্দ করতেন।
১৯৫৯ সালে তরুণ মজুমদার, শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখার্জি তিন বন্ধু মিলে যৌথভাবে যাত্রিক নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। এই বছরই যাত্রিকের অধীনে সুচিত্রা সেন এবং উত্তম কুমার অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্র “চাওয়া পাওয়া” মুক্তি পায় এবং তরুণ মজুমদার পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই চাওয়া পাওয়া সিনেমাটির জনপ্রিয়তার বিষয়ে নতুন করে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এরপর ১৯৬২ তে দিলীপ মুখার্জির নেতৃত্বে তারা তৈরি করেছিলেন কাঁচের স্বর্গ সিনেমাটি, ব্যাস এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি পরিচালক তরুণ মজুমদার কে।
এবার সময় এসে গেছিল যাত্রীকের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের প্রতিভার জোরে কিছু করার। তরুণ মজুমদার ১৯৬৫ সালে দুটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন – সৌমিত্র চ্যাটার্জির সাথে একটুকু বাসা এবং বসন্ত চৌধুরীর সাথে আলোর পিপাসা।এরপর তৈরি হয় পলাতক, বালিকা বধু, নিমন্ত্রণ, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী ও গণদেবতার মত সফল সিনেমা। তিনি ১৯৬৭ সালে বালিকা বধু সিনেমাটি মুক্তি পায় । বালিকা বধূ সিনেমাটি বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই তৈরি হয়েছিল এবং এই সিনেমাটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।তরুণ মজুমদার তার ‘গণদেবতা ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনি যে শুধু সফল ছবিই উপহার দিয়েছেন তা নয়, তিনি একের পর এক সফল জুটি ও উপহার দিয়েছেন ।
তরুণ মজুমদার পুরস্কার
তরুণ মজুমদার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এমন একজন পরিচালক যিনি বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য বিখ্যাত। তিনি মোট ১৭টি পুরস্কার পেয়েছেন, সেগুলি হল চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি বিএফজেএ পুরস্কার, পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এবং একটি আনন্দলোক পুরস্কার পেয়েছেন। এই সমস্ত পুরস্কারের পাশাপাশি তাঁকে ১৯৯০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী প্রদান করা হয়েছে।
যৌথভাবে পরিচালিত চলচ্চিত্রের তালিকা
- চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)
- কাঁচের স্বর্গ (১৯৬২)
- পালাতক (১৯৬৩)
তরুণ মজুমদার পরিচালিত চলচ্চিত্রের তালিকা
- আলোর পিপাসা (১৯৬৫)
- একটুকু বাসা (১৯৬৫)
- বালিকা বধূ (১৯৬৭)
- রাহগির (১৯৬৯)
- নিমন্ত্রণ (১৯৭১)
- কুহেলি (১৯৭১)
- শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩)
- ঠগিনী (১৯৭৪)
- ফুলেশ্বরী (১৯৭৪)
- সংসার সীমান্তে (১৯৭৫)
- বালিকা বধূ (১৯৭৬-হিন্দি)
- গণদেবতা (১৯৭৮)
- দাদার কীর্তি (১৯৮০)
- শহর থেকে দূরে (১৯৮১)
- মেঘমুক্তি (১৯৮১)
- খেলার পুতুল (১৯৮২)
- অরণ্য আমার (১৯৮৪)
- অমর গীতি (১৯৮৪)
- ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫)
- পথভোলা (১৯৮৬)
- আগমন (১৯৮৮)
- পরশমণি (১৯৮৮)
- আপন আমার আপন (১৯৯০)
- পথ ও প্রাসাদ (১৯৯১)
- সজনী গো সজনী (১৯৯১)
- কথা ছিল (১৯৯৪)
- আলো (২০০৩)
- ভালোবাসার অনেক নাম (২০০৬)
- চাঁদের বাড়ি (২০০৭)
- ভালোবাসার বাড়ি (২০১৮)